রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা হলে খরচ হবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে ঢাকার চলমান প্রকল্প, একনেকে অনুমোদিত প্রকল্প, প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ সরকারিভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং রাজধানীতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে তার খরচ দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে নির্ধারিত এবং সম্ভাব্য এ ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক ছাড়িয়ে যাবে। যানজট নিরসনে আরো যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং প্রস্তাবিত যেসব প্রকল্পের খরচ এখনো উল্লেখ করা হয়নি তা বাস্তবায়িত হলে মোট খরচ সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
পাহাড় পরিমাণ এ অর্থ খরচ হচ্ছে মূলত পাতাল রেল, মেট্রোরেল ও দীর্ঘ রুটে কয়েকটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে।
যানজটের সহজ সমাধানে না গিয়ে পাহাড় পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে এসব প্রকল্প বিষয়ে অনেক আগ থেকে বিশেষজ্ঞ পর্যায় সতর্কতা ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে পাতাল রেল ও দীর্ঘ রুটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকে এটাকে দেশ ও রাজধানীর জন্য শুধু অপূরণীয় ক্ষতি নয় বরং আত্মঘাতী মনে করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে যানজট সমাধানের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় ছিল বিকেন্দ্রীকরণ এবং বিআরটির মতো সহজ গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এতে তেমন অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হতো না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ নয় বরং সারা দেশের মানুষকে রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানানোর আয়োজন করা হচ্ছে। তাদের মতে বিকেন্দ্রীকরণ না করে যানজট সমাধানের জন্য যত উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন তা একসময় অকার্যকর হয়ে যাবে নিয়ন্ত্রণহীন রাজধানীমুখী মানুষের ভারে।
সরকারি সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) অধীনে বর্তমানে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল এমআরটি লাইন ৬ নির্মাণের কাজ চলছে।
ডিএমটিসিএল পাঁচটি এমআরটি লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এর মধ্যে গত ১৫ অক্টোবর ডিএমটিসিএলের দু’টি এমআরটি লাইন তথা এমআরটি১ ও এমআরটি৫ (নর্দান) একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর খরচ ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এমআরটি ১ এর দৈর্ঘ্য ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার। অবস্থান বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত। এমআরটি ৫ (নর্দান) এর দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। অবস্থান হেমায়েতপুর-আমিনবাজার-গাবতলী-মিরপুর ১-মিরপুর ১০-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুনবাজার-ভাটারা পর্যন্ত।
এ রেল লাইনের কোথাও পাতাল এবং কোথাও সারফেস অর্থাৎ ভূমিতে। বর্তমানে চলমান এমআরটি ৬ ছাড়া বাকি সব রেললাইন কোথাও পাতাল এবং কোথাও সারফেস করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের অপর এমআরটি লাইনগুলো হলো এমআরটি ২ গাবতলী-চট্টগ্রাম রোড, এমআরটি ৪ কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ ও এমআরটি ৫ (সাউদার্ন)-গাবতলি-দাশেরকান্দি। এর দৈর্ঘ্য ৫৭ কিলোমিটার। এমআরটি ৫ সাউদার্নের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে চলমান ও প্রস্তাবিত কয়েকটি প্রকল্পের খরচ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে চলমান প্রকল্পগুলো হলো : ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে। খরচ ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। মূল অংশের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। অবস্থান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী)। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনেক প্রতিবেদনে সংশোধিত এ প্রকল্পের খরচ ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি প্রকল্প হলো গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ অংশ। চুক্তিমূল্য ৯ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। অবস্থান : মূল প্রকল্প গাজীপুর থেকে শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অংশ উত্তরা হাউজ বিল্ডিং থেকে টঙ্গী চেরাগ আলী মার্কেট পর্যন্ত।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে। প্রাক্কলিত ব্যয় ১১ হাজার ২৪ কোটি টাকা। অবস্থান ঢাকা ও গাজীপুর জেলা। দৈর্ঘ্য ২৪ কিমি.। তবে ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবরে একনেকে অনুমোদন দেয়া এ প্রকল্পের খরচ ১৭ হাজার কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
ঢাকা শহরে সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প। প্রাক্কলিত ব্যয় ২২৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
অবস্থান : প্রাথমিকভাবে চারটি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আপাতত রুট-১ অর্থাৎ টঙ্গী-বিমানবন্দর-কাকলী-মহাখালী-মগবাজার-পল্টন-শাপলাচত্বর-সায়েদাবাদ-নারায়ণগঞ্জের সাইন বোর্ড পর্যন্ত এবং রুট-২ অর্থাৎ আমিনবাজার-গাবতলী-আসাদগেট-নিউমার্কেট-টিএসসি-ইত্তেফাক-সায়েদাবাদ পর্যন্ত এই দু’টি অংশে সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর বাইরে আরো কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে, যার খরচ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে যানজট নিরসনে দু’টি প্রস্তাবিত প্রকল্প উল্লেখ করা হয়েছে। এ দু’টি হলো ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট (মিডল/আউটার রিংরোড) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। খরচ ৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
আরেকটি ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প। খরচ ৮৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত অন্য প্রকল্পগুলো হলো ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে।
আরেকটি প্রকল্প হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম ২২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। খরচ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ৮৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
শান্তিনগর-কেরানীগঞ্জ ১৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২০১৭-১৮ বাজেট বক্তৃতায় এ কথা জানান তখনকার অর্থমন্ত্রী। এমআরটি লাইন ২, ৪ ও ৫ (সাউদার্ন ) এবং প্রস্তাবিত ঢাকা-পূর্ব-পশ্চিম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও শান্তিনগর-কেরানীগঞ্জ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ উল্লেখ করা হয়নি।
রাজধানীর যানজট নিরসনে পাতাল রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ পরিকল্পনার শুরু থেকে নয়া দিগন্তে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অনেকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা জাতিসঙ্ঘ এসকাপের সাবেক পরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ, বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক প্রফেসর মাহবুব-উন্-নবী, প্রফেসর সারওয়ার জাহান, প্রফেসর খ ম মনিরুজ্জামান এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুল বারী প্রমুখ বিশেষজ্ঞের বরাতে এসব প্রকল্পের ভালো ও বিপজ্জনক দিক তুলে ধরা হয়েছে অনেকবার।
গতকাল শনিবার রাতে প্রফেসর সারওয়ার জাহানের কাছে সর্বশেষ এসব প্রকল্প বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যানজট নিরসনে প্রথমে দরকার ছিল সহজ যত পথ আছে তা অবলম্বন করা। অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাসনির্ভর বিআরটি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সহজ পথে না গিয়ে ব্যয়বহুল পথে হাঁটছে কর্তৃপক্ষ। ব্যয়বহুল এসব প্রকেল্পর ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনেক উন্নত দেশ পাতাল রেল র্নিমাণ করেছে, কিন্তু আমাদের মতো দেশে এটা কতটা সঠিক তা ভাবা দরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে যানজট নিরসনে বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি সবার আগে করণীয় ছিল রাজধানীর আয়তন ও তাতে কী পরিমাণ জনসংখ্যা থাকবে তা নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। এখন বরং মানুষকে রাজধানীমুখী করার মহাআয়োজন চলছে। তা ছাড়া বর্তমানে যানজটের নামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তাতে ক্ষুদ্র গাড়িকে উৎসাহিত করা হচ্ছে অথচ সবার আগে দরকার ছিল ক্ষুদ্র গাড়ি নিয়ন্ত্রণ। তাদের মতে, ঢাকামুখী মানুষের স্রোত যদি থামানো না যায় তাহলে যানজট নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। সেজন্য দরকার সারা দেশে বৈষম্যহীনভাবে উন্নয়ন ছড়িয়ে দেয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাতাল রেলের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প না নিয়ে বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের শতভাগ ব্যবহার ও অধিকতর সারফেস রেল নির্মাণ করা যেত। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। পাতাল রেলের অনেক ভালো দিক থাকলেও অনেকের মতে পাতাল রেল নির্মাণ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী পরিচালনা খরচ অত্যন্ত উচ্চ। বিপুল ভর্তুকি ছাড়া পাতাল রেল চলে না বিশ্বের কোথাও। তা ছাড়া যেখানে রাজধানী ঢাকা প্রায় প্রতি বছর অতি বৃষ্টিতে পানির নিচে তলিয়ে যায় সেখানে এর ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকে।
এ দিকে সড়ক পরিবহন, স্থানীয় সরকার ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় সড়ক ও পরিবহন খাতে গত আট বছরে সরকার খরচ করেছে ৬ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৯২৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করা হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি।