টানা এক বছরের উপরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছে। গত বছরের মার্চ থেকে শুরু হওয়া এ প্রাদুর্ভাব মাঝখানে কিছুটা কমলেও চলতি বছরের শুরু থেকেই দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এতে স্থানীয় বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্পকারখানায়।
এ সময়ে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ভয়াবহ আকারে কমে গেছে। কমে গেছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও। শিল্পের মূল উপকরণ আমদানিতে এ বিপর্যয়ের কারণে শিল্পকারখানায় বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন শিল্পকারখানা সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং করোনার প্রভাবে অনেক চালু কারখানাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিল্প খাতে সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার হার কমেছে ২৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি কমেছে ৩৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছিল শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। আমদানি কমেছিল ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ।
পুরো অর্থবছরে গড়ে আমদানি কমেছিল ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে আমদানি কমেছিল ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে কমছে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ। এতে নতুন শিল্প স্থাপনের গতি ও চালু শিল্প আধুনিকায়নের গতি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্র্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করলে আরো দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির কমেছে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। একই সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা কমেছিল ১ দশমিক ২৪ শতাংশ। আমদানি বেড়েছিল ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু পুরো অর্থবছরের হিসাবে এ খাতের আমদানি কমেছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, নতুন শিল্প স্থাপন ও চালু শিল্প আধুনিকায়ন কম হওয়ার কারণে শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া করোনার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় পণ্য বিক্রি কম হচ্ছে। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরো সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, চলমান পরিস্থিতিতে কেউ বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। কারণ বর্তমানে বিনিয়োগ করলে ওই বিনিয়োগে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে না; বরং ঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকবে। কারণ নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করা হলো। এ জন্য নেয়া হলো ব্যাংকের বিনিয়োগ; কিন্তু নতুন শিল্পকারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা না গেলে ব্যাংকের বিনিয়োগ ফেরত দেয়া সম্ভব হবে না। এতে ওই বিনিয়োগ শতভাগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ১৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। রফতানিমুখী শিল্পগুলো ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে। সেগুলো দিয়ে পণ্য তৈরির পর রফতানি করে। গত দুই অর্থবছর ধরে এ খাতের কাঁচামাল আমদানিতেও মন্দা চলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা কমেছিল ৭ দশমিক ০২ শতাংশ এবং আমদানি কমেছিল ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই শিল্প খাতে মন্দা যাচ্ছে। এর প্রভাবেই শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে বলা হয়, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শুধু দেশী বিনিয়োগ বাড়ালে হবে না। বিদেশী বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। দু’টির সমন্বয়ে শিল্প খাতের বিকাশ ঘটবে।