বেশ কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার অন্যতম বিষয় হলো, পেঁয়াজ। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশের রফতানি নিষিদ্ধ করা হয়তো একটি কারণ। আবার এর পেছনে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ও খোঁজা হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে কি না, সরকার খুঁজে দেখবে। এগুলো আমার কাছে নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য বলেই মনে হয়। আমরা আসলে ‘সিন্ডিকেটের অর্থনীতি’র কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি যারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা যদি স্বাভাবিক ‘পেঁয়াজের অর্থনীতি’ হতো, তাহলে এর সমাধানও হয়ে যেত সহজে। ফলন মার খেলে কিভাবে চাহিদা পূরণ করতে হবে, তার অনেক ফর্মুলা অর্থনীতির বইয়ে দেয়া আছে। কিন্তু ইস্যু আসলে পেঁয়াজ নয়। এখান থেকে যে নিরেট সত্যটি আমাদের সামনে চলে আসে, তা হলো- আমাদের গোটা বাজারব্যবস্থা গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে জিম্মি। এটা পশ্চিমা করপোরেট কালচারের অংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করা এবং একচেটিয়াত্ব কায়েমের নতুন হাতিয়ার হচ্ছে বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন। প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে চিৎকার-চেঁচামেচি করা হলেও বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই পাঁচ থেকে ছয়টি বহুজাতিক করপোরেশনের হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে। বিশ্বের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ খাদ্য ও পানীয়, কৃষিজাত কাঁচামাল, খনিজ ও ধাতব পদার্থের আমদানি-রফতানি এদের মাধ্যমে হচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্য বলতে গেলে এখন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।
আমাদের এখানকার বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটগুলো একটি আন্তর্জাতিক চেইনের অংশ। করপোরেট সংস্কৃতির কথা বলে আমরা যখন মুক্তবাজারের দিকে যাচ্ছি, তখনই আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। বিশ্বের অর্থনীতি এতে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়ে। এই পঙ্গুত্বের হাত থেকে মুক্তি দিতে ধনী দেশগুলোর পরামর্শ, প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ‘দাতা’ সংস্থা। এসব সংস্থা গরিব দেশগুলোক ‘দারিদ্র্যের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেয়া’র নামে ঋণ দিয়ে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাহায্য করে। কিন্তু প্রায় ৭০ বছর পর এসে দেখা যায়, ওইসব সংস্থার ঋণ নিয়ে, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে খুব কম দেশই উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে পেরেছে। আসলে সাহায্যের ছদ্মাবরণে দাতা সংস্থাগুলো তৃতীয় বিশ্বে এমন সব অপরাধ করে চলেছে, যার ফলে দেশগুলো হয়ে পড়েছে আরো বেশি সাহায্যনির্ভর। এসব দেশের জনগণ আরো বেশি দরিদ্র হয়েছে, তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে বহু গুণ।
আজ আমরা পেঁয়াজের সমস্যায় আছি, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানে না- আমাদের ধানসহ অনেক ফসলের প্যাটেন্ট পশ্চিমা বিশ্বের হাতে। তারা অনুমতি না দিলে, তাদের কাছ থেকে বীজ কেনা না হলে, আমরা ধান চাষ করতে পারব না। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্য বহুজাতিক করপোরেশনগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের এখানে যেসব ‘বাণিজ্য সিন্ডিকেট’ গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সাথে ওইসব বহুজাতিক করপোরেশনের যোগাযোগ না থাকার কোনো কারণ দেখছি না। এরা সবাই করপোরেট কালচারের অংশ।
পেঁয়াজের দাম বাড়ার ঘটনা প্রমাণ করছে, আমাদের অর্থনীতি ক্রমেই মুক্তবাজার থেকে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই নিয়ন্ত্রণ কিছু করপোরেশন ও বহুজাতিক সংস্থার হাতে। ভারত রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর মিসর, পাকিস্তান, তুরস্কসহ অনেক দেশ থেকে প্লেনে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসা হচ্ছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি। এই আমদানিকারক কিন্তু সরকার নয়, বেসরকারি কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। আমরা দেখলাম, কিভাবে মুহূর্তের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে পেঁয়াজ নিয়ে আসার সব প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলতে পারছে। এতে ভাবনার খোরাক রয়েছে। বাইরের অবস্থা দেখেই বিচার করলে হবে না। আমরা বাইরের ব্যথাটি দেখছি, কিন্তু ভেতরে যে ক্যান্সার তৈরি হয়েছে, সেই খবর নেই। আমরা যদি রাতারাতি প্লেনে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসার মতো দক্ষ হই, তাহলে অর্থনীতিতে ‘সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ড’ বলে যে কথা আছে- সে বিষয়ে কেন আগাম ধারণা করতে পারলাম না? ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ হবে, তা তো অনেক আগে থেকেই জানা থাকার কথা। কারণ সেখানে বন্যা হয়েছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস সবাই জানে। তাহলে এটা কেন জানা গেল না? এতে বোঝা যায়, এই সঙ্কট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা, যা উপরে উল্লিখিত চক্রটি তৈরি করেছে।
আমরা চাহিদা-সরবরাহের বিষয়টি তো হিসাব করতে পারি। পেঁয়াজ হলো মৌসুমি পণ্য। এক মওসুমে উৎপন্ন হয়ে সারা বছর চাহিদা মেটায়। ফলে আমরা জানি কখন সববরাহ বেশি থাকবে, কখন এর ঘাটতি হবে। ঘাটতি হলে বিকল্প কী উপায়ে তা পূরণ করা যাবে সেটিও আমাদের জানা। পেঁয়াজের সঙ্কট আসলে ‘বড় রোগের পূর্বলক্ষণ’। আমরা লবণের সঙ্কটের কথাও শুনেছি। চালের দাম বাড়ছে। আগামীকালই হয়তো আরেক পণ্যের দাম বৃদ্ধির কথা শুনব। তার পরদিন একাধিক পণ্যের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর হাত দিতে শুরু করেছে এই নিয়ন্ত্রণবাদী চক্র। গুটিকতেক দেশীয় করপোরেট জায়ান্টের হাতে অর্থনীতি বন্দী হয়ে পড়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। এই চক্র ভাঙতে হলে আমাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক দর্শন প্রয়োজন। অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হওয়ার মতো কিছু করা আমাদের উচিত হবে না। এখানে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনারও দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের ভিশনের অভাব তো রয়েছেই। যদি জানি আমার লাইফলাইন ভারতে, তাহলে তারা তো আমার কাছ থেকে সুযোগ নেবে।
এ অবস্থার উত্তরণে আমাদের বিদেশনির্ভরতা কমাতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া দরকার। চাহিদা-সরবরাহের তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে। এ জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। কৃষিকে চাঙ্গা করার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না। কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার এমন অনেক খাতে সাবসিডি দেয়, যে খাতে না দিয়ে কৃষি খাতে দেয়া হলে কৃষকের উপকার হতো। আমরা অস্ত্র কেনার পেছনে বহু অর্থ খরচ করছি। কিন্তু গবেষণা খাতে মঞ্জুরি দেয়া হয় নামমাত্র। এগুলো উপেক্ষিত খাত। কারণ, এখানকার সুফল মানুষ সহসা দেখতে পায় না। অর্থনীতির প্রতিটি অংশ পরস্পর সংযুক্ত। আমরা দৃশ্যমান উন্নতির দিকে যাচ্ছি, কিন্তু অদৃশ্য বৈষম্য যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সেদিকে নজর নেই। বৈষম্য যখন দৃশ্যমান তখন কিন্তু সমাজে বিপ্লব ঘটে। এটা ঐতিহাসিক সত্য। জনগণ যখন জেগে উঠে তখন সমাজ বিপ্লব সঙ্ঘটিত হয়। পেঁয়াজসঙ্কট আসলে আমাদের সে ইঙ্গিত দিচ্ছে। পেঁয়াজ সাত দিন খাবো না- এটা সস্তা রাজনৈতিক সেøাগান হতে পারে। পেঁয়াজ হয়তো সাত দিন না খেয়ে থাকা যেতে পারে, কিন্তু চাল-আটার সঙ্কট যদি সামনে আসে, তখন কি কেউ বলবে যে, চাল-আটা সাত দিন না খেয়ে থাকব? তাই বলতে হয়, এটা বড় কোনো অসুখের লক্ষণ। এই সঙ্কটের পথ ধরে অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। তাই যারা দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এটা ক্যাসিনোতে দু’-একটি অভিযান চালানোর মতো বিষয় নয়। এর সাথে হাতে গোনা কয়েকজন নয়, কোটি কোটি মানুষের জীবন জড়িত। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক আমাদের ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু তারা এসব কথা বলে তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করছে। তারা নানা কৌশলে আমাদের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। তারা যা ঋণ দেয়, তার বহুগুণ আদায় করে নেয়। তারা অনুন্নত দেশগুলোকে খরচ কমাতে বলে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোকে বলে না, অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে না। পশ্চিমাদের বাতিল করা অস্ত্র কিনতে তৃতীয় বিশ্বকে বাধা দেয় না। তাই আমি বলছি, জনগণের মৌলিক প্রয়োজনগুলো সরকারকে অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে। এটাই অর্থনৈতিক ইতিহাসের শিক্ষা। এ ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ না নিলে পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। কয়েকটি মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কয়জন ব্যবসায়ীকে জেল-জরিমানা দিয়ে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যায় না।
আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আগের মতো জনদরদ নেই। আমাদের দেশে স্বাধীনতার আগে যারা রাজনীতি করেছেন, তারা অর্থ-সম্পদের জন্য রাজনীতি করেননি। ব্রিটিশ শাসনামলে যাদের ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ করতে দেখেছি, পরে যারা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি করেছেন, তাদের মধ্যে কয়জন ব্যবসায়ী ছিলেন? যত দূর মনে পড়ে, ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের ১০ জন শীর্ষ মুসলিম চিন্তাবিদ ও রাজনীতিকের একটি তালিকা করা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কোনো ব্যবসায়ী ছিলেন না। সেখানে আমাদের সিরাজগঞ্জের দুইজন ছিলেন- মওলানা ভাসানী ও ইসমাইল হোসেন সিরাজী। সে সময় পাক-ভারত উপমহাদেশের ১০ জন খ্যাতনামা ব্যক্তির মধ্যে দু’জনই সিরাজগঞ্জের- বিষয়টি আমাকে কিশোর মনকে খুবই উজ্জীবিত করেছিল। তাদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তাদের জীবনভর প্রচেষ্টা ছিল কিভাবে জনগণের উপকার করা যায়। এখন ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসছেন অর্থ দিয়ে ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’ কেনার জন্য। ক্ষমতা ব্যবহার করেই তারা আবার ব্যবসা করছেন। ক্যাসিনো ঘটনায় প্রায় সবাই বলেছে, টাকা দিয়ে আমরা ক্ষমতা কিনেছি। অথচ আগের রাজনীতিবিদরা অর্থ দিয়ে ক্ষমতা কেনেননি। তারা দেখেছেন, জনগণের উপকার কিভাবে হবে। ফলে তারা আজো মানুষের মনে বেঁচে আছেন। অর্থবিত্তের চেয়ে তাদের ‘সোস্যাল নিড’ ও ‘স্পিরিচুয়াল নিড’ ছিল বেশি। মানুষের উপকার করার মনোবৃত্তি নিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এটাই আজ সামাজিক দুর্দশার অন্যতম কারণ। বর্তমান ও বিগত কয়েকটি পার্লামেন্টে এমপিদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী মহল থেকে এসেছেন। এটা হলো আজকে আমাদের পেঁয়াজসঙ্কটের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট।
অন্য দিকে, আমরা যে বাণিজ্যযুদ্ধ দেখছি, তা ‘ডকট্রিন অব কমপিটেটিভ অ্যাডভানটেজ’, ‘প্রিন্সিপল অব ফ্রি ট্রেড’-এর বিরুদ্ধে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, মুক্তবাজারের কথা বলে আসলে মানুষকে করা হচ্ছে বিভ্রান্ত। আসলে ‘মুক্তবাজার’ বলে এখন আর কিছু নেই। মুক্তবাজার, বৈশ্বিক গ্রাম এসব বুলি হলো সামাজিক শোষণের হাতিয়ার। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আমাদের মতো অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো অসহায়। সব কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই সমস্যা সমাধানের একটি পথ আমাদের সামনে খোলা আছে, তা হলো জাতীয় ঐক্য। যেকোনো জাতীয় সমস্যা সমধানের জন্য জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই।
লেখক : ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতির অধ্যাপক, কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ