মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪১ পূর্বাহ্ন

রাজধানীতে সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকা কঠিন

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ২৮৪ বার

জীবনযাত্রার ব্যয় অব্যাহতভাবে বৃদ্ধির ফলে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে রাজধানীতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে বসবাসকারী সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে আলোচিত বিষয়।

সম্প্রতি অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এ অবস্থাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবাপণ্যের দাম। এর সাথে প্রতি বছর রাজধানীতে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। বাড়ছে সন্তানের শিক্ষার খরচ। সব কিছু মিলিয়ে অনেকের অবস্থা করুণ। দীর্ঘ দিন ধরে রাজধানীতে বসবাসের কারণে অনেকে চাইলেও গ্রামে চলে যেতে পারছেন না।

অন্যদিকে রাজধানীতে তাদের পক্ষে টিকে থাকাও ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। সীমিত আয় থেকে বাড়িভাড়া, সন্তানের লেখাপড়ার মতো নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের খরচ ঠিক রাখতে গিয়ে মৌলিক চাহিদা খাদ্যের খরচও কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বড় কোনো অসুখ না হলে ডাক্তার ও ওষুধের কথা ভাবতে পারেন না অনেকে। অনেকেই বছরের পর বছর সন্তান নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন না। পারছেন না প্রিয় সন্তানদের অনেক আবদার ও সখ পূরণ করতে।

রাজধানীতে বসবাস করলেও অনেকের আসলে গ্রামের অনেক গরিব পরিবারের চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন সেকথা কাউকে তারা বোঝাতেও পারেন না বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। উচ্চশিক্ষিত কিন্তু সীমিত আয়ের অনেকে বলেছেন, গ্রামের অনেক গরিব ও শহরের বস্তির অনেকের চেয়েও তাদের অবস্থা খারাপ।

গ্রামের গরিব লোকজন বর্তমানে অনেক উৎস থেকে অনেক ধরনের সহায়তা পান এবং গ্রামে তেমন আর শোচনীয় গরিব মানুষ নেই। কিন্তু রাধধানীর অনেক শিক্ষিত লোকের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। আর এর মূলে রয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

পেঁয়াজের স্মরণকালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার আড়ালে বেড়ে গেছে চাল, আটা, ময়দা, তেল, আলু, চিনিসহ আরো কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। ফলে আরেক দফা কঠিন হলো রাজধানীর সীমিত আয়ের মানুষের জীবন। অপর দিকে ঘৃর্ণিঝড়সহ দুই দফা বৃষ্টির কারণে বাজারে চলছে শীতের সবজির আকাল।

রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা ও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনায়েত বলেন, এক বছর আগেও মাসে বিুদ্যৎ বিল আসত পাঁচ থেকে ৬০০ টাকা করে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১৮ শ’ থেকে ১৯ শ’ টাকা করে। এরই মধ্যে দু’দিন আগে আবার দেখলাম সরকার বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাসের বিল ছিল ৫০০ টাকা। সেটা এখন সাড়ে ৯০০ টাকা। তবে সম্প্রতি মিটার বসানোয় খরচ কেমন হয় তা জানি না।

এনায়েত তার সীমিত আয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি তিন রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। প্রতি বছর এক হাজার টাকা করে বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়। বাড়িওয়ালা এ মাস থেকে পানির বিল ৫০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা করেছেন। বিদ্যুৎ বিলের বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে কাতর স্বরে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে মাসে দুই হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়া কেমন করে সম্ভব?

এনায়েত জানান, তার তিন সন্তান। এর মধ্যে দু’টি প্রাথমিকে এবং একজন মাধ্যমিকে পড়ে। বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর কারণে সন্তানের শিক্ষার ব্যয় তার সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে। কিন্তু তিনি চাইলেও এ ব্যয় কমাতে পারছেন না। তাহলে লেখাপড়াই বন্ধ করে দিতে হয় উল্লেখ করে এনায়েক বলেন, রাজধানীতে বেসরকারি স্কুল মানেই খরচ আর খরচ। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে অন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধির কারণে আমরা দারিদ্র্য হয়ে পড়েছি। ২৮ বছর ধরে রাজধানীতে বাস করছি। চাইলেও এখন আর গ্রামে ফিরে যেতে পারছি না। গ্রামে সে ধরনের কোনো আয়ের ব্যবস্থাও নেই। ফলে বাধ্য হয়ে কোনোমতে টিকে আছি রাজধানীতে।
এনায়েতের মতো অবস্থা রাজধানীর অনেক বাসিন্দারই। সীমিত আয়ের অনেকে জানিয়েছেন, বাড়ি ভাড়া, সন্তানের লেখাপড়াসহ কিছু নির্দিষ্ট ব্যয় ঠিক রাখতে গিয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছেন না তারা।

অনেকে বলেছেন, বাজার থেকে সব সময় কম দামে বেছে বেছে নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। মৌলিক কিছু পণ্য ছাড়া কখনো কোনো বাড়তি খাবার যেমন ফল, তৈরি খাবার, একটু বেশি দামের মাছ, গোশত এবং মুখরোচক কোনো কিছু সন্তানদের তারা কিনে দিতে পারেন না। সন্তানদের নিয়ে কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেন না।

রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় অতিমাত্রায় বৃদ্ধির কারণে অনেকে যেমন পরিবার নিয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছেন, তেমনি অনেকে আবার রাজধানীতে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরুই করতে পারছেন না। যদিও তারা দীর্ঘ দিন ধরে এখানে কর্মরত। অনেকে বিয়ে করলেও স্ত্রী সন্তান গ্রামে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে।

গত তিন দশকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সস্তার দিন শেষ হয়ে যায় মূলত ২০০৬ সাল থেকে। ২০০২ সাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম চড়া হতে থাকে। অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে দুর্যোগ বয়ে আনে। বিপুলসংখ্যক মানুষের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে পড়ে এর বিরুপ প্রভাব। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিজনিত নানামুখী সঙ্কট ক্রমে তীব্র হয়েছে রাজধানীতে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০১ সালে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে শতকরা মাত্র ১ ভাগ। ২০০২ সালে হঠাৎ করে তা ৪ ভাগে উন্নীত হয়। ২০০৫ সালে এটা বেড়ে শতকরা ৬ ভাগে দাড়ায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তখন এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছে যে, ২০০৬ সালে শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায় জিনিসপত্রের দাম। আর ২০০৭ সালে এটা আরো বেড়ে হয় শতকরা ১৮ ভাগ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। ২০০১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় শতকরা ৫ ভাগ। আর ২০০৬ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৩ ভাগ। ২০০৭ সালে বাড়ে শতকরা ১৬ ভাগ। ক্যাবের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ হার নির্ণয়ে চাল ডালের সাথে শাড়ি, লুঙ্গি, ফলসহ হরেক রকম জিনিস রয়েছে। এসব বাদ দিলে মূলত অপরিহার্য নিত্যপণের দাম বৃদ্ধির হার এ সময় অনেক বেশি ছিল।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com