দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর বছরেও সরকার স্বাস্থ্যখাতের জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থের বেশিরভাগ খরচ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এজন্য অর্থনীতিবিদদের অনেকে স্বাস্থ্যখাতে সক্ষমতার অভাব ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার প্রশ্ন তুলেছেন।
তারা বলেছেন, করোনা মহামারী মোকাবিলায় চাহিদার বিপরীতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারায় ভ্যাকসিন কার্যক্রম থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঙ্কট থাকছে। পরিকল্পনামন্ত্রী মনে করেন, স্বাস্থ্যখাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে এমন পরিস্থিতি হচ্ছে।
চলতি অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বাজেটের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার পাশাপাশি থোক বরাদ্দও ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা।
মহামারী মোকাবিলা করার জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটেও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ চলতি বছরের তুলনায় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এবারও প্রস্তাব থাকছে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখার।
কিন্তু চলতি অর্থবছরেই স্বাস্থ্যখাতে থোক বরাদ্দ ও বাজেটের অর্থ খরচের ক্ষেত্রে অন্যান্য খাতের তুলনায় একেবারে নিচের দিকে রয়েছে।
অন্যতম একজন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর বলেছেন, স্বাস্থখাত সব সময় বরাদ্দের ভিত্তিতে পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্বল ছিল। এই প্রেক্ষাপটে চিকিৎসাসেবার দৈন্যদশা থাকলেও তা নজরে আসতো না। কারণ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নিম্ন আয়ের মানুষ বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল।
ড. মনসুর উল্লেখ করেছেন, মহামারীর কারণে স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতাগুলো আলোচনায় আসছে। এই সময় আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম বা যন্ত্র বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু এগুলো বিমানবন্দরেরই পড়ে ছিল কয়েক মাস। এ ঘটনা নিয়ে এখনো সমালোচনা হয়।
‘থোক বরাদ্দ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল নয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এসব বরাদ্দের ৪০ ভাগও তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি,’ বলেন ড. মনসুর।
তিনি আরো বলেছেন, ‘কেনাকাটার ক্ষেত্রে দেখেছি, ৩৫০টি আইসিইউ ও শত শত ন্যাজাল ক্যানোলাসহ বিভিন্ন যন্ত্র বিদেশ থেকে এনে ছয় মাস বিমানবন্দরে ফেলে রাখা হয়েছিল। এখানেই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতার প্রমাণ মেলে।’
দেশে গত বছর মহামারী দেখা দেয়ার পর চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়েছিল। অক্সিজেন, আইসিইউ ও হাসপাতাল আসনের সঙ্কট নিয়ে তখন উদ্বেগ তৈরি হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতে খরচ করা যে সম্ভব হয়নি, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মহামারী মোকাবিলায়। তিনি খরচ করতে না পারার ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাবকে বড় কারণ হিসেবে দেখেন।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যয় করতে না পারার কারণ হচ্ছে, তাদের সক্ষমতার অভাব। তারপর যতটুকু ব্যয় হচ্ছে, সেটা অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে আটকে থাকছে। এজন্য করোনা আসার পর যে ধরনের স্বাস্থ্য অবকাঠামো থাকা দরকার, তা একেবারে নেই। হাসপাতালের বেড, আইসিইউ, অক্সিজেন বা যন্ত্রপাতি এমনকি মানবসম্পদ যেমন- ডাক্তার ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী যা আছে, তা কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থার জন্যও যথেষ্ট নয়।’
অবশ্য উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারার যে সব অভিযোগ বা বক্তব্য আসছে, তা মানতে রাজি নন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, সরকারি অর্থ ব্যয়ের যে জটিলতা-সেই বাস্তবতায় যতটা করা সম্ভব, তারা তা করেছেন।
তবে ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কথা স্বীকার করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মন্ত্রী বলেন, মহামারী সামলাতে যন্ত্রপাতির জন্য আমরা নিয়ম ভেঙে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সাপের্টের দু’টি প্রকল্পকে একসাথে করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যয়টা যতটা গতিতে আশা করেছিলাম, ততটা হয়নি। একটা গ্যাপ আছে অবশ্যই।
মন্ত্রী মান্নান আরো বলেছেন, আমরা একটা গ্যাপে পড়ে গেলাম। এজন্য ভ্যাকসিন নিয়ে সমস্যা হলো। দোষারোপের প্রশ্ন নয়, এটা বাস্তব। এখন আমাদের ভ্যাকসিনের জন্য অন্য জায়গায় যেতে হচ্ছে। সুতরাং টাকা আমাদের রাখতেই হবে। এজন্য থোক বরাদ্দ এবারো বাড়ছে, থোক বরাদ্দও রাখা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আগামী অর্থ বছরের বাজেট সংসদে পেশ করার কথা রয়েছে ৩ জুন।
সূত্র : বিবিসি