মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আজ ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করবেন তিনি। প্রস্তাবিত বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য, আগামীর বাংলাদেশ’।
দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি বাজেট হতে যাচ্ছে ৫০তম এ বাজেটে। আলোচিত এই বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আসন্ন ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এটি চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বেশি।
প্রাণঘাতী করোনার ধাক্কা সামলাতে এবারের বাজেটে আয়ের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে সরকার। সেজন্য বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বেশি।
চলতি অর্থবছরে এ আয়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। যদিও বাজেটে মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৩ কোটি টাকা। আয়ের মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান নেওয়া হবে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
বাজেট প্রসঙ্গে সম্প্রতি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী জানান, দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর লক্ষ্য নিয়েই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হবে। এ বাজেটে সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষকে সঙ্গে রাখা হবে। আগামী বছর একই ধারা থাকবে বলে জানান তিনি।
আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পূরণে কর খাত থেকে মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআরবহির্ভূত কর হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
বড় বাজেটের ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ হিসেবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ৬ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা, ঋণ ও অগ্রিম ৪ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা এবং খাদ্য হিসাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৯৭ কোটি টাকা।
আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণও অনেক বেড়েছে। আগামী বছর অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ ৬ দশমিক ১ শতাংশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। টাকার অংকে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। যেখানে চলতি অর্থবছরে অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫.৯ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে অনুদান ব্যতীত সামগ্রিক ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ শতাংশ।
আগামী বাজেটে আটটি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে করোনা নিয়ন্ত্রণে অর্থায়ন ও স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ নিশ্চিত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণ করা। এছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজ সফলভাবে বাস্তবায়ন, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে স্বল্প ও বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ, অধিক খাদ্য উৎপাদনে কৃষিতে গুরুত্ব এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় আগামী বাজেটেও করপোরেট করে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে। অপরিবর্তিত থাকছে মার্চেন্ট ব্যাংক, সিগারেট, জর্দা, গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত মোবাইল কোম্পানির করহার। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর সাড়ে ৩২ থেকে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ী, পণ্য পরিবেশক, ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেনের ওপর ন্যূনতম আয়কর কমানো হচ্ছে। বর্তমানে ৩ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলে লাভ বা ক্ষতি যা-ই হোক, দশমিক ৫০ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে করহার কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত নতুন শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর পরবর্তী প্রথম তিন বছর ন্যূনতম করহার দশমিক ১০ শতাংশ থাকছে। তবে মোবাইল অপারেটরদের লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ এবং তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম করহার ১ শতাংশ বহাল থাকছে।
এছাড়া এক ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি উৎসাহিত করতে বাজেটে বিশেষ কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। তাদের কর ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমানে কোম্পানি আইনে গঠিত কোম্পানিকে সাড়ে ৩২ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। পাশাপাশি এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। ১ হাজার ৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, মোবাইল ফোন এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দুই বছর বাড়াছে।
অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশে প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ, ইনকজেট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এআইও, ডেস্কটপ, নোটবুক, নোটপ্যাড, ট্যাব, সার্ভার, কিবোর্ড, মাউস, বারকোড ও কিউআর কোড স্ক্যানার, পিসিবিএ/মাদারবোর্ড, পাওয়ার ব্যাংক, রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ, মডেম, নেটওয়ার্ক ডিভাইস/হাব, স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, ইয়ারফোন, হেডফোন, এসএসডি/পোর্টেবল এসএসডি, হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, পেনড্রাইভ, মাইক্রো এসডি কার্ড, ফ্ল্যাশ মেমোরি কার্ড, সিসিটিভি, মনিটর, প্রজেক্টর, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ই-রাইটিং প্যাড, ইউএসবি ক্যাবল, ডিজিটাল ঘড়ি, বিভিন্ন প্রকার লোডেড পিসিবি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রী উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে দুই বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার দেশে উৎপাদন করলে উপকরণ-যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট দেওয়া লাগবে না। কমপ্লায়েন্স বাড়াতে নতুন ভ্যাট আইনে আগাম করপ্রথা চালু হয়। বাজেটে ভ্যাট আইন আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে আগাম কর (এটি) হার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ হচ্ছে। এ ছাড়া রিফান্ড জটিলতার কারণে কয়েকটি শিল্পকে আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদহার দুটোই কমানো হচ্ছে। বর্তমানে ভ্যাট ফাঁকির ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রয়েছে। এটি কমিয়ে ফাঁকির সমপরিমাণ অর্থ জরিমানার বিধান হচ্ছে। এ ছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দেওয়ায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সরল সুদের বিধান রয়েছে। এটি ১ শতাংশ করা হচ্ছে।
করোনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে বিশেষায়িত ও সাধারণ হাসপাতাল নির্মাণে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিভাগীয় শহর ছাড়া অন্য জেলায় ২০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ২৫০ শয্যার সাধারণ হাসপাতাল নির্মাণ করলে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা পাওয়া যাবে।
আইটি খাতে বিদ্যমান ২২টির সঙ্গে আরও পাঁচটি সেবাকে করের বাইরে রাখা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস এবং ফ্রিল্যান্সিং। কৃষি যন্ত্রপাতি- থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন হারভেস্টর, রোটারি টিলার, উইডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ার (ঝাড়াই কল) আমদানিতেও আগাম কর প্রত্যাহার হচ্ছে। সবুজ শিল্পায়ন উৎসাহিত করতে ‘গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড ফর এক্সপোর্ট’ তহবিলে আরও ২০ কোটি ডলার দেওয়া হচ্ছে। রপ্তানি খাতে সব ধরনের কর অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মতো করপোরেট কর, রপ্তানি আয়ে উৎসে কর ও নগদ প্রণোদনায় উৎসে কর দিতে হবে।