কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কিছুদিন ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কার্যত তার মুক্তি আটকে আছে দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি মামলার কারণে। এর মধ্যে একটি মামলায় ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে জামিন শুনানি হওয়ার কথা। বিএনপির শীর্ষনেত্রীর জামিনের বিষয়ে আদালতের কী সিদ্ধান্ত আসে, সেদিকে তাকিয়ে আছে দলটি। কারণ এ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে।
এদিকে উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে-খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সরকারের মনোভাবে কোনোরকম নমনীয়তা দেখা যায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের মামলায় জামিনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে রকম রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন, তেমন কিছুর আভাস মেলেনি। অর্থাৎ পর্দার আড়ালে বা প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে আলোচনার কোনো খবর জানা নেই কারও।
অন্যদিকে দলীয় চেয়ারপারসনের জামিন ইস্যুতে ধীরে ধীরে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে বিএনপি। এবার জামিন না হলে একদফা আন্দোলনে মাঠে নামবে বলে হুশিয়ারি এসেছে দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে। সাম্প্রতিককালের একটি মামলায় বিএনপি নেতকর্মীদের জামিনপ্রাপ্তিতে শীর্ষনেত্রীর মুক্তির ব্যাপারেও তারা আশাবাদী হয়ে উঠছেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি আলোচনা শোনা যায় যে, খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য প্যারোল নিয়ে বিদেশে গেলে তাকে জামিন দেওয়া হতে পারে। এ জন্য তাকে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে হবে। এ মুক্তিও হবে কঠিন শর্তযুক্ত। এতে খালেদা জিয়ার পরিবার সম্মত বলেও জানা গেছে। তবে খোদ খালেদা জিয়া নিজেই এ প্রক্রিয়ায় মুক্তি নেবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন।
সরকারের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, সরকার সুশাসন চায়। এখানে আইন সবার জন্য সমান। আওয়ামী লীগের কেউ অপরাধ করে ছাড় পাচ্ছে না। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের মতো দোর্দ- প্রতাপশালী নেতাও এখন কারাগারে। ক্যাসিনোকারবারিদের মধ্যে দলের প্রভাবশালী নেতাদেরও বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয়নি। এখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, কিংবা সাবেক এমপি, সরকার কিংবা বিরোধীদলীয় এমপি কিংবা নেতাদের আইনের বাইরে দেখার সুযোগ নেই। অপরাধীকে আমরা অপরাধী হিসেবে দেখছি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন-বিএনপি আইন মানে না, আদালত মানে না। উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। হুমকি না দিয়ে বড় আাইনজীবী নিয়োগ করে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে।
বিএনপি অবশ্য মনে করে, খালেদা জিয়ার দ- পুরোপুরি রাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্র। তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। ক্যাসিনোকারবারি যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা ওই পর্যায়ের নেতা নন। এর পেছনে বড় যেসব নেতাও সম্পৃক্ত আছেন, তারা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। শুদ্ধি অভিযান স্রেফ লোক দেখানো।
গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ৫ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া জামিন না পেলে বুঝতে হবে শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে তিনি জামিন পাননি। সেদিন জামিন না পেলে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু হবে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথে কঠোর কর্মসূচির পক্ষে। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপও রয়েছে। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের অনেক নেতাও মনে করেন, রাজপথে আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না। এ লক্ষ্যে দলের ভেতরেও চলছে গোছানোর কাজ।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, আদালতের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ স্পষ্ট। এ কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন কোনো অপরাধ না করেও মাসের পর মাস কারান্তরীণ। আমরা আদালতের প্রতি সম্মান রেখে চলেছি। তাতে কিছু না হলে ফয়সালা হবে রাজপথে।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার কারামুক্তি আটকে আছে দণ্ডপ্রাপ্ত জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায়। বর্তমানে এ দুটি মামলায় জামিন চেয়ে করা আবেদন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। তাই আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর কারামুক্তির বিষয়টি। সেখানে একটি মামলাতেও যদি তার জামিন আটকে যায়, তা হলে কারামুক্তিও আটকে যাবে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আশা করছেন, এবার আপিল বিভাগ থেকে জামিন পাবেন তিনি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তার অন্যতম প্রধান আইনজীবী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, প্রধানত অসুস্থতা এবং তার বয়সের দিক বিবেচনায় জামিন চাওয়া হয়েছে। অতীতে বহু মামলায় এ ধরনের দ-প্রাপ্তদের আপিল বিভাগ থেকে জামিন দেওয়ার নজির রয়েছে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সাবেক এমপি আবদুল ওয়াহহাবকে এই আপিল বিভাগ জামিন দিয়েছে।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত মামলায় পর্যন্ত জামিনের নজির রয়েছে। আমরা আশা করছি সর্বোচ্চ আদালত ন্যায়বিচার করবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা জামিন পাব, যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম চাপ না আসে। আজকাল সরকার তো সব সময় আদালতের ওপর হাত দিয়ে রাখে। বিচার বিভাগ সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে ন্যায়বিচার করলে খালেদা জিয়ার জামিন হবে। আদালতের ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে। আদালত সবরকম প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে খালেদা জিয়াকে জামিন দেবেন-এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
কী কারণে খালেদা জিয়া জামিন না পেতে পারেন-এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটি বিচারাধীন বিষয়। এ ব্যাপারে এখন কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন শুনানিকালে গত বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত প্রতিবেদন চান আদালত। গত ৩১ জুলাই নিম্নআদালতে সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সরাসরি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। গত ১৪ নভেম্বর হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে আপিল বিভাগের কাছে জামিন চান তার আইনজীবীরা।
অন্যদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা বৃদ্ধি করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে আপিল করেন খালেদা জিয়া। ওই আপিলের সঙ্গে তার একটি জামিনের আবেদনও রয়েছে। এ মামলায় নিম্নআদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদ- দিলেও দুদকের সাজা বাড়ানোর আবেদন গ্রহণ করে হাইকোর্ট তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। এ রায় বাতিল ও খালাস চেয়ে খালেদা জিয়া আপিল বিভাগে আপিল করেন। এখন এই আপিল ও জামিনের আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
আরও মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩৭ মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা। ৩৭ মামলার মধ্যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ৫টি দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হয়। এগুলো হলো-জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লার খনি দুর্নীতি মামলা। এগুলোর মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি ছাড়া বাকিগুলোর বিচার চলছে ঢাকার বিভিন্ন বিশেষ জজ আদালতে। বাকি ৩২টি মামলা বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে হয়। যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি ও ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে এসব মামলা হয়। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৩টি ও নড়াইলে ২টি মামলা রয়েছে। বাকিগুলো ঢাকার। ৩৭ মামলার মধ্যে ১৮টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে উচ্চআদালতের নির্দেশে। এ ছাড়া কিছু মামলা তদন্তাধীন ও কিছু মামলার বিচার চলমান। বর্তমানে দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি ছাড়া সবই খালেদা জিয়া জামিনে আছেন বলেও জানান তার আইনজীবীরা।
কারাভোগ : গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেডিক্যাল বোর্ডের অধীনে চিকিৎসাধীন।