‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।’ হৈমন্তীর বাবা ঠিকই বলেছিলেন; কিন্তু ভারতশাসিত কাশ্মীরের মানুষ তো রাজ্য-অধিকার এবং সাংবিধানিক বিশেষ অধিকার ‘ছাড়িয়া’ দেননি, অধিকার ফেরত চাওয়াতে তাই ‘বিড়ম্বনা’র কিছু নেই। যে ক্ষমতাবলয় বছর দুয়েক আগে তাদের সে অধিকার হরণ করেছিল, সেই কেন্দ্র থেকে শোনা যাচ্ছে- অন্তত রাজ্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এ বিষয়ে তিনি ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘সময় হলেই’ সমাধা, আবার রাজ্য-মর্যাদার স্বীকৃতি পাবে জম্মু-কাশ্মীর। প্রশ্ন হচ্ছে- সময় হবে কত দিনে?
কাশ্মীরি আট রাজনৈতিক দলের ১৪ নেতার সঙ্গে বৃহস্পতিবার দিল্লিতে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে কাশ্মীরের প্রথম নারী মুখমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিসহ সাবেক চার মুখ্যমন্ত্রী অংশ নেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, বৈঠকে রাজ্য-মর্যাদা ফেরানো ছাড়াও স্থানীয় নির্বাচন ও নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়েও আলাপ হয়েছে। তবে মুফতিসহ স্থানীয় নেতারা রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে কেন্দ্রের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, যে মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ২০১৯ সালে ৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের মধ্য দিয়ে।
বৈঠকে মোদি বলেছেন, তিনি কাশ্মীরকে আবার রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সময় হলেই কাশ্মীরকে সেই স্বীকৃতি দিয়ে দেবে। তবে কবে- এ বিষয়ে মোদি-শাহ কিছুই বলেননি।
সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করার পর কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়। ওই বছর ৩১ অক্টোবর থেকে পশ্চিমে জম্মু ও কাশ্মীর এবং পূর্বে লাদাখ কেন্দ্রশাসিত হয়ে আসছে।
গেল দশকে বিজেপি ওই অঞ্চলে কৌশলগত অগ্রগতি লাভ করে মেহবুবা মুফতির সঙ্গে জোট সরকারে থাকার সুযোগ করে নিয়ে। বিরোধীরা ২০১৫ সালে মেহবুবার ওই বিচ্যুতিকে ‘হিমালয়সম ভুল’ বলে নিন্দা জানিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে বিজেপি সমর্থন সরিয়ে নিলে মেহবুবা সরকারের পতন ঘটে। এরপর কেন্দ্র থেকে মোদি সরকার কাশ্মীরের বাকি ‘অপমান’ পূর্ণ করেন।
অবশ্য বিজেপির সঙ্গে জোটবাঁধা নিয়ে অনুতপ্ত নন মেহবুবা। দিল্লি বৈঠকের দিন তিনি হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কাশ্মীরের জনগণের স্বার্থে এবং ওই অঞ্চলের সুবিধার জন্য কেন্দ্রকে প্রভাবিত করতে ওটাই ছিল তার কাছে ‘বাধ্যতামূলক কৌশল’; কিন্তু সেই জোটসঙ্গীই তাকে গ্রেপ্তার করেছিল, এমনকি পাসপোর্ট পর্যন্ত সঙ্গে রাখতে দেয়নি। তার পরও মোদিকে কেন বিশ্বাস করছেন তিনি? মেহবুবা বলেছেন, ‘দেখুন, নরেন্দ্র মোদি কেবল একজন ব্যক্তিমানুষ নন। তিনি এই দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি প্রধানমন্ত্রীর ওপর ভরসা করছি। আমাদের বিশেষ অধিকার কিন্তু পাকিস্তান, চীন বা যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা কোনো ব্যক্তি দেয়নি, দিয়েছিল ভারতের সংবিধান।’
রাজ্য-মর্যাদা ফেরতের কথা বললেও ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ পুনরায় বহাল করার ব্যাপারে বরাবরই ‘না’ বলে আসছে বিজেপি। কাশ্মীর কি রাজ্য স্বীকৃতিতেই খুশি? মেহবুবা বলছেন, ‘এমনকি [অটল বিহারি] বাজপেয়ি ও অন্য বড় নেতারা, যেমন জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেল ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। বিজেপির ইশতেহারে তো আর দেশ চলবে না; দেশ চলবে সংবিধান মতে। ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত কিছুতেই আমরা ক্ষান্ত হচ্ছি না।’
আদৌ কি বিজেপি তার সুর বদলাবে, কাশ্মীরকে বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে? রাজ্য স্বীকৃতিও কি সত্যি সত্যি ফেরত দেবে? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- যে তৃণমূল নেতাকে চব্বিশে মোদিবিরোধী মহাজোটের মূলত্রাতা হিসেবে দেখা হচ্ছে- বলেছেন, ‘কাশ্মীরের রাজ্য-মর্যাদা কেন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, এ আমার মাথায় ঢুকছে না।’ মমতা ঠিকই বলেছেন, ‘সে কারণে দুনিয়াজুড়ে ভারতের দুর্নাম রটেছে।’