যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক অঞ্চল ঢাকা মহানগর। কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশ সফল করতে অনেকাংশেই নির্ভর করতে হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ওপর। আর ক্ষমতাসীন দল হলে তো আরও গুরু দায়িত্ব, প্রতিহত করতে হয় বিরোধীদের নানা আন্দোলনও। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এক নেতাকে একাধিক কমিটিতে ঠাঁই দেওয়া, অনুপ্রবেশকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা, দীর্ঘদিন ধরে থানার পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়া, কোনো কোনো থানায় শীর্ষ পদে কেউ না থাকা- এমন আরও নানা কারণে রীতিমতো ঝিমিয়ে আছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য কেন্দ্র থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়া হলেও কর্ণপাত করছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। দল গোছানো বাদ দিয়ে নিজেদের বলয় তৈরিতেই ব্যস্ত নেতারা। তার জন্য শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজ করতেও দ্বিধা করছেন না তারা। ত্যাগীদের সরিয়ে দিয়ে এর সুযোগ নিচ্ছেন অনুপ্রবেশকারীরা। দিন দিনই প্রকাশ্যে আসছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। আর এভাবে চলতে থাকলে নিজেদের ঐতিহ্য হারাবে উপমহাদেশের অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বিরোধীদের আন্দোলন প্রতিহত করা তো দূরের কথা, নিজেদের বলয় ধরে রাখাটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ থানা পল্টনে আওয়ামী লীগ এখন ‘নেতৃত্বশূন্য’। ক্যাসিনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তবা জামান পপি। আর সভাপতি এনামুল হক আবুলেরও বয়স হয়েছে। কাউন্সিলর হওয়ায় সেই দায়িত্ব পালনেই বেশি মনোযোগী। এ কারণে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এই থানায় দলীয় কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির। লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী দেলোয়ার হোসেন মারা গেছেন। সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান জামালও সামাল দিতে পারছেন না। ফলে তৈরি হচ্ছে গ্রুপিং ও মতোবিরোধ।
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও রাজনীতিতে প্রায় নিষ্ক্রিয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়নি দীর্ঘ সময়ে। এই সুযোগে ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিলের মতো থানায় দলের রাজনীতিতে নেই কোনো শৃঙ্খলা। প্রায় ১২ বছর ধরে কমিটি হয় না রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার যাত্রাবাড়ী থানায়। সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু উপনির্বাচনে হয়েছেন সংসদ সদস্য। আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন হারুনর রশিদ মুন্না। তবে অজ্ঞাত কারণে এই এলাকায় নতুন নেতৃত্ব আসে না। হয় না পূর্ণাঙ্গ কমিটিও।
শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বয়স্ক হওয়ায় বেশি সময় দিতে পারেন না। সাধারণ সম্পাদক কাজী হাবীবুর রহমান হাবুও রাজনীতিতে এখন আর অ্যাকটিভ নেই। পুরো এলাকাই নিয়ন্ত্রণ করেন সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার সামিউর রহমান অভি। ফলে ওই এলাকার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চেইন অব কমান্ড না থাকায় রয়েছে চাপা ক্ষোভ। বংশাল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফা। পুরো পরিবারই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজেও পিডিপি (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি) থেকে এসে সরাসরি বংশাল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বনে গেছেন। তার ভাই ও ভাতিজা যথাক্রমে বিএনপি ও যুবদলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা।
মহানগরের নেতৃত্ব বদল হলেও খিলগাঁও, সবুজবাগ, মুগদা, মতিঝিল, শাজাহানপুর, পল্টন, রমনা, লালবাগ, চকবাজার, বংশালে ছয় বছরের অধিক সময় ধরে চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি। আর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরায় কমিটি হয় না দীর্ঘ এক যুগ। ফলে ওইসব এলাকায় বিরাজ করছে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থবিরতা। অসঙ্গতির এখানেই শেষ নয়, দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে- এক নেতা থাকতে পারবেন না একাধিক পদে। এমনকি যেসব নেতা কাউন্সিলর হয়েছেন, তারাও মহানগরের কমিটিতে থাকতে পারবেন না- এমন নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু সব নির্দেশনাই উপেক্ষিত।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ফজলুর রহমান পর্বত। একই সঙ্গে তিনি কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য সিরাজুল ইসলাম র্যাডো চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে। উপদেষ্টা আবুল কাশেম আবার আওয়ামী হকার্স লীগের সভাপতি। মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি হাজী মো. সাহিদ সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আজহার আবার শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগেরও একই পদে। মহানগরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এফএম শরিফুল ইসলাম শরিফ ওয়ারি থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। মহানগরের কোষাধ্যক্ষ মো. হুমায়ুন কবির ওয়ারি থানা আওয়ামী লীগেরও একই পদ সামলাচ্ছেন। মহানগরের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য জসীম উদ্দিন আহমেদ নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আরেক সদস্য রাকিব হাসান সোহেল সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগেও একই চিত্র। এএবিএম মাজহার আনাম উত্তর মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েও দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। উত্তরের সদস্য আব্দুল মান্নান আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আরেক সদস্য সারোয়ার আলম সামলাচ্ছেন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কখনো দল না করেও কেউ কেউ বিভিন্ন থানা কমিটির সম্পাদকীয় পদে আসীন হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে মোটা অংকের টাকার লেনদেনের। আর কেন্দ্রের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঢাকার প্রায় সব কাউন্সিলরকেই ঠাঁই দেওয়া হয়েছে কার্যনির্বাহী কমিটিতে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘মহানগর কমিটির পর আমরা থানা বা ওয়ার্ড কমিটিতে হাত দিতে পারিনি। যদি সেগুলোতে হাত দিতে পারতাম তাহলে আর এই অসঙ্গতি থাকতো না। ইতোমধ্যে আমরা ইউনিট কমিটি গঠনে কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তু করোনার কারণে তাও থেমে আছে। সমস্যা হচ্ছে যারা থানায় এতদিন দায়িত্বে আছেন এখন তো হঠাৎ করে তাদের সরিয়ে কাউকে দায়িত্বে দিতে পারি না। এর জন্য নতুন কমিটির প্রয়োজন। আশা করি তা শুরু হয়ে যাবে।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহম্মেদ মন্নাফী আমাদের সময়কে বলেন, ‘যারা নগরের কমিটিতে আছে তাদের থানা কমিটির পদ ব্যাকেন্ড (খালি) হয়ে গেছে। তারা আর থানার পদ ব্যবহার করতে পারবেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড ও লকডাউনের কারণে আমরা ওয়ার্ডে বা থানায় হাত দিতে পারছি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমে ইউনিট পরে ওয়ার্ড ও থানার কমিটিতে হাত দেব। সেই সঙ্গে বিতর্কিত কেউ থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’