পা জোড়ায় শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল। রেফারির বাঁশি কানে আসতেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। কান্না লুকাতে চোখমুখ ঢাকলেন। অবশ্য পারলেন না। হৃদয়ভাঙা কান্না তো অনেক হয়েছে। এবার প্রাপ্তিতে কাঁদলেন মেসি। সতীর্থরা এসে জড়িয়ে ধরতেই শুরু হলো সেলিব্রেশন। ২০০৭, ২০১৪ (বিশ্বকাপ), ২০১৫ ও ২০১৬-তে হতে হতেও হয়নি। ওই ফাইনালের মঞ্চে ব্যর্থ হতে হয়েছিল মেসিকে। অবশেষে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা উপহার দিলেন। ক্লাব ফুটবলে এমন কোনো শিরোপা নেই যা জেতেননি।
বার্সেলোনার হয়ে জেতা ট্রফিতে উপচে পড়ছে ঘর। দলীয় আর ব্যক্তিগত সব অর্জনের কত না স্মারক। তবুও লিওনেল মেসির মনে ছিল হাহাকার; জাতীয় দলের হয়ে অর্জনের থলি ছিল শূন্যই। সেই আক্ষেপ ঘুচল এবার। জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে ৭৬ গোলদাতা মেসি এই প্রথম শিরোপা জিতলেন আর্জেন্টিনার জার্সিতে (সিনিয়র)। ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকা বা বড় কোনো আসরে শিরোপা জিতল। আহ! দুঃখ শুধু একটাই। যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা আজ আর বেঁচে নেই।
ঐতিহাসিক মারাকানায় ফাইনাল। ম্যাচের বয়স তখন ২২ মিনিট। রড্রিগো ডি পলের চমৎকার পাস ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারদের বুক চিরে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার কাছে গিয়ে পৌঁছায়। ডি মারিয়ার সামনে ছিলেন গোলকিপার। তার মাথার ওপর দিয়ে বল চালান করে দেন তিনি। দৃষ্টিনন্দন গোলে আর্জেন্টিনা ফাইনালের প্রথমেই লিড নেয়। আর সেখানে নেইমার এদিন ছিলেন তার ছায়ায়। অবশ্য রিচালিসন একবার ৫২ মিনিটে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল অফসাইড। ফলে ১-০ গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। ১৯৩৭ সালে সর্বশেষ ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়েছিল তারা। ১৪ বছর পর প্রথম ফাইনাল ছিল এটি কোপায়। আর আর্জেন্টিনা ১৯৯৩ সালে সর্বশেষ কোপা আমেরিকা জেতে। এরপর তারা আর সফল হয়নি শিরোপা জিততে। মেসি তার ক্যারিয়ারের পঞ্চম ফাইনালে এসে সফল হয়েছেন। যেখানে পেলে বা ম্যারাডোনা কখনো কোপা জিততে পারেননি। সেখানে মেসি সফল হলেন। পেলের শুভেচ্ছাবার্তাও পেয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি।
ফাইনাল শুরুর আগেই রোজারিতে প্রার্থনায় বসেছিলেন সেখানকার অধিবাসীরা। মেসি এই শহরে জন্মেছিলেন। জয়ের আনন্দে অনেকে কেঁদেছেন। অনেকে আবার মিষ্টি বিলি করার পাশাপাশি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বার্সেলোনা, বুয়েন্স আয়ার্স, মারাকানা, রোজারিও মিলেমিশে এক হয়েছিল এদিন। এমনকি পুরো বিশ্বের মেসি ও আর্জেন্টিনা ভক্তদের জন্য ছিল অন্যরকম উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ্য।
নেইমার ব্রাজিলের হয়ে এখনো কোপা আমেরিকা জেতেনি। খেলা শেষে তাকে সান্ত¡না দেন মেসি। দুজন তো ভালো বন্ধুও। বার্সেলোনায় একসঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন তারা। ড্রেসিংরুমে পরে আড্ডাও দিয়েছেন নেইমার ও মেসি। কোপায় টুর্নামেন্ট সেরা ও সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি খেলা শেষে বলেছেন, ‘আমি অনেকবার এই শিরোপার কাছে গিয়েছি। আমি জানতাম এটা হওয়ার ছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই কারণ তিনি চেয়েছেন বলেই হয়েছে। ব্রাজিলের মাটিতে এমন জয় অবিশ্বাস্য।’ উল্লেখ্য, মারাকানায় ১৯৫০ সালের পর আর্জেন্টিনার কাছে হারল ব্রাজিল। ওই বিশ্বকাপে উরুগুয়ের কাছে হেরেছিল ব্রাজিল। এরপর ব্রাজিল ৫টি বিশ্বকাপ জয় করে। তবে ব্রাজিলকে হারাতে বেশি খুশি মেসি। তিনি আরও বলেন, ‘এই ম্যাচটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারণ আমরা ব্রাজিলকে ফাইনালে হারিয়েছি। আমি বলে বোঝাতে পারব না কতটা আনন্দ আজ আমার হচ্ছে। আর্জেন্টিনার এই দল এটা ডিজার্ভ করে।’
মেসি তার ক্লাব ক্যারিয়ারে বার্সেলোনার হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেছেন। ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগের পাশাপাশি রয়েছে ৬টি ব্যালন ডি‘অর। আবারও ব্যালন ডি‘অর জিততে যাচ্ছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন মেসি। অলিম্পিক স্বর্ণও ছিল। কিন্তু দেশের হয়ে এই প্রথম শিরোপা জিতলেন।
২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ। ৩৪ বছর বছর বয়সী মেসি তখন ৩৫ এ থাকবেন। সেটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। আর্জেন্টাইনরা এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। আর সে স্বপ্ন ১৯৮৬ সালে পূরণ হলেও ভেঙেছে ১৯৯০ ও ২০১৪ সালে। মেসির হাত ধরেই আগামী বিশ্বকাপ জিতবে, এটাই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা থাকবে আর্জেন্টিনার।