বিএনপির অঙ্গসংগঠন নয়টি এবং সহযোগী রয়েছে আরও দুটি সংগঠন। এর মধ্যে ছাত্রদল ছাড়া বাকি দশটি সংগঠনই চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। ফলে দলের নানা কর্মসূচি, এমনকি বিভিন্ন আন্দোলনেও তেমন দেখা মেলে না এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের। এমন বেহাল দশা কাটাতে তাই পর্যায়ক্রমে কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। চলতি সপ্তাহেই কৃষক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কথা রয়েছে। এর পর মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, শ্রমিকদল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল ও মুক্তিযোদ্ধা দলের নতুন কমিটি দেওয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ না হলেও ছাত্রদলের নতুন কমিটি নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন।
সংগঠনগুলোর পদপ্রত্যাশীরা জানান, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ও করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের পরও নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা কাজ করছে। কমিটি বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। বিএনপি নেতারা অবশ্য জানিয়েছেন, নেতাকর্মীদের হতাশা কাটাতে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের কথা ভাবা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভেতরে ভেতরে নেতা নির্বাচনের কাজও শুরু হয়েছে। এমন খবরে অবশ্য সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে নানাভাবে লবিং-তদবির শুরু করেছেন পদপ্রত্যাশীরা। তা ছাড়া বর্তমানে ছাত্রদলের সাবেক পাঁচ শতাধিক নেতা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন, যাদের কোনো পদ নেই। তাই এদের যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে স্থান দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। বিএনপির
স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর দলের শক্তি বাড়াতে পুনর্গঠনের ওপর জোর দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর পরই বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয় ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এদিকে সংগঠনগুলোর নতুন কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, ‘পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। করোনা ও রাজনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।’ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানও বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার সারাদেশের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে কারাগারেও আছেন। তাই সবকিছুই ভাবতে হচ্ছে।’
কৃষক দল : দীর্ঘ ২২ বছর পর গত ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে শামসুজ্জামান দুদু ও হাসান জাফির তুহিন নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। তাই চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু অথবা হাবিব উন নবী খান সোহেল রয়েছেন হাইকমান্ডের ভাবনায়। কিন্তু তারা রাজি না হলে ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম অথবা বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে এর দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম ও হাবিবুর রশিদ হাবিব, বিএনপির সহসম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, কৃষক দলের সাবেক সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন, সাবেক কৃষক দল নেতা মাইনুল ইসলাম ও তকদীর হোসেন জসীম।
মহিলা দল : আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মহিলা দলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটি গত বছরের ৪ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ করা হয়। এর মধ্যে একাধিক গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত মহিলা দল নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন দলের শীর্ষনেতারা। এ অবস্থায় গত বছর থেকে নতুন কমিটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ আলোচনার মূল কেন্দ্রে অবশ্য আফরোজা আব্বাসই রয়েছেন। তিনি যদি সভাপতি হন তা হলে কমিটি এক রকমের হবে, না হলে নতুন কমিটি ভিন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেনÑ শিরীন সুলতানা, নিলোফার চৌধুরী মনি, সুলতানা আহমেদ, হেলেন জেরীন খান, বিলকিস ইসলাম প্রমুখ।
যুবদল : সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর ১১৪ সদস্যের আবার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি সেই নেতৃত্ব। তবে সারাদেশে সাংগঠনিক ৮২ জেলার প্রায় সব কটিতেই কমিটি হয়েছে এর মধ্যে। পৌর, থানা, উপজেলা পর্যায়েও ৯৩৫টি ইউনিটের মধ্যে কমিটি হয়েছে ৭শটিরও বেশির। যুবদলের এসব কমিটি গঠনে অবশ্য বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ আছে।
দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুবদলের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ হতেও পারে, নাও পারে। পূর্ণাঙ্গ করা হলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাকের নাম ঘোষণা করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংগঠন ও হাইকমান্ডের কাছে আলোচনায় আছেনÑ বর্তমান কমিটির সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, নুরুল ইসলাম নয়ন, মামুন হাসান, এসএম জাহাঙ্গীর, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ বেশ কয়েকজন।
স্বেচ্ছাসেবক দল : ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষের এক বছর পর গত বছর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। তবে সারাদেশে সাংগঠনিক ৮১টি জেলার প্রায় সব কটিরই কমিটি সম্পন্ন হয়েছে সংগঠনটির। এ ছাড়া ছয় শতাধিক জেলা ও থানার কমিটিও হয়েছে। গত বছর করোনা আক্রান্ত হয়ে সংগঠনের সভাপতি শফিউল বারী বাবুর মৃত্যুর পর নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েলকে সভাপতি করার পক্ষেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অনেকে মতামত দিয়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, ইয়াসিন আলী, ফকরুল ইসলাম রবিন, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাজীব আহসানসহ বেশ কয়েকজন।
ছাত্রদল : ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদল সূত্র জানায়, বর্তমান নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে না পারলেও প্রথমবারের মতো সারাদেশে পৌর, উপজেলা ও কলেজ শাখায় ১ হাজার ৪৪৮টির মতো কমিটি দেওয়া হয়েছে। যদিও ছাত্রদলের নেতাদের বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থার মাঝে কমিটির মেয়াদ পার হলেই নতুন করা হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন কমিটিতে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন ইকবাল হোসেন শ্যামল, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, আমিনুর রহমান আমিন, রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, মো. আমানউল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের এপ্রিলে শ্রমিক দলের কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল-গ্রুপিংয়ে হযবরল অবস্থা। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারির গঠিত আংশিক কমিটিকে গত বছর ২৩ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ করা হলেও জাসাসের কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে আহ্বায়ক ও আবদুর রহিমকে সদস্য সচিব করা হয়। এ কমিটিরও কোনো কার্যক্রম নেই। ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হককে আহ্বায়ক এবং মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারকে সদস্য সচিব করে ওলামা দলের ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি কেবল মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মেয়াদত্তোর্ণ তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি চায়। সে প্রস্তুতিও আমাদের আছে। ইতোমধ্যে ৭০টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন মাত্র ১২টি কমিটি আছে। এগুলোতে অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা রয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠেই কমিটি দেওয়া হবে।’