দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়ছে। এর বড় প্রমাণÑ সাম্প্রতিক সময়ে আমদানিচাহিদা বেড়ে যাওয়া; অন্য দিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। ফলে আমদানিপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আগে যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল, শুধু দেশীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় তা এখন ১০৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির বেশির ভাগ আমদানিনির্ভর হওয়ায় টাকার মান কমার সরাসরি প্রভাব পণ্যমূল্যের ওপর পড়ে। এতে এক দিকে যেমন পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ছে, অন্য দিকে বাণিজ্যঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবর চার মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র চার মাসে পণ্য বাণিজ্যঘাটতি হয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এভাবে ঘাটতির পরিমাণ বাড়লে বছর শেষে পণ্য বাণিজ্যঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা, চলতি মাসের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। আমদানি পর্যায়ে করপোরেট ডিলিংয়ে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত। রফতানি আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে টান পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পণ্যের আমদানি ব্যয়ের ওপর। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্যঘাটতি বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে বাণিজ্যঘাটতিতেও।
ব্যাংক খাত সূত্রে জানা যায়, বছরের শুরুতেই প্রবাসী আয়প্রবাহের পাশাপাশি রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ছিল। সেই তুলনায় আমদানিচাহিদা বাড়েনি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অনেকটাই সহনীয় ছিল। চার মাস ধরে প্রবাসী আয়প্রবাহ ঠিক থাকলেও টানা রফতানি আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। উল্টো আমদানিচাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট থাকায় ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়তই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ধরনা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জ্বালানি তেল, ভোগ্যপণ্যসহ কিছু ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টাকার জোগান দিচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ না বাড়ায় কিছু ব্যাংকের ডলারের সঙ্কট এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাক্সিক্ষত হারে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করতে না পারাই এর কারণ। আবার রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। ফলে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে বাজার থেকে হয় ডলার কিনতে হচ্ছে, না হয় নির্ধারিত কমিশনের বিপরীতে ধার নিতে হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন কিছু করার নেই বটে; নীতিমালা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে আটকাতে না পারলেও সতর্ক করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু নীতিমালায় না থাকার দোহাই দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া বিবেচনাপ্রসূত নয়। কারণ, দেশে ইতোমধ্যে প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ডলারের দামের অনুপাতে টাকার মান কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে, জনজীবনে দুর্ভোগের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছানো। সরকারকে এখনই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, যাতে সাধারণের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে।