‘এক চোর যায় চলে, এই মন চুরি করে…’- এমন গান শুনতে আমাদের ভালোই লাগে। কারণ এসব গানে চুরির বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে হাসি, তামাশা আর রোমান্টিসিজমের আবরণে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে চুরির সঙ্গে হাসি, তামাশা কিংবা রোমান্টিসিজমের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই। বাস্তবে চুরি মানেই ভয়ঙ্কর এক অপকর্ম। ওই অপকর্ম নানাভাবে প্রভাব ফেলে জনমনে। এ কারণে চুরির ঘটনা ঘটার কথা শুনলেই মানুষের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। মানুষ তেড়ে যায় চোরের গায়ে হাত তোলার জন্য। কিন্তু সব চোরের গায়ে হাত তোলার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থাকে না। তবে রক্ত ঠিকই টগবগায়, হাত ঠিকই নিশপিশ করে। টিকা বর্তমানের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস। করোনাকে যদি আমরা নিকষ অন্ধকার হিসেবে বিবেচনা করি, তা হলে টিকা হচ্ছে ওই অন্ধকারে এক টুকরো আলো। ওই আলো একদিন পুরো অন্ধকারকে দূর করে দেবে- এমন বিশ^াস আমাদের মনে। কিন্তু একটি চুরি এ বিশ^াসকে নড়বড়ে করে দিয়েছে অনেকটাই। সাধারণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে চুরিটাকে হয়তো পুকুরচুরির মতো বিশাল কোনো চুরি মনে হয় না। তবে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে এটা শুধু পুকুরচুরি নয়, রীতিমতো সাগরচুরি। চুরিটাকে পুকুরচুরির মতো বিশাল কোনো চুরি মনে হয় না তখন- যখন সংখ্যা দেখি। অর্থাৎ মাত্র ২০ ডোজ। কিন্তু সাগরচুরির মতো বিশাল চুরি মনে হয় তখনই- যখন এ চিন্তা মাথায় আসে, সত্যি কি ২০ ডোজ? আড়াল-আবডালে আরও হাজারো ডোজ যায়নি তো চোরদের হাতে? সব চুরি কি ধরা পড়ে? সব চোরের নাম কি প্রকাশ হয়? না, এই চিন্তা উদ্ভট কোনো চিন্তা নয়। বরং এই চিন্তার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পৃক্ততা অনেক বেশি- যেহেতু এমনটাই হয়ে থাকে অহরহ।
দেখা যায়, ধরা পড়ে চুনোপুঁটি আর অধরা থেকে যায় রাঘববোয়ালরা। ফলে এমন প্রশ্ন মনে আসা খুবই স্বাভাবিক- ২০ ডোজ টিকা চুরি করে যে ধরা পড়েছে, সে তো চুনোপুঁটি। তা হলে রাঘববোয়ালটা কে? তার বা তাদের চুরি করা টিকার সংখ্যা কত? আর তারা কত গভীর জলের মাছ যে, ধরাই পড়েনি? আমরা যদি বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি, তা হলে ধরে নিতে পারি- এখানে কোনো রাঘববোয়াল নেই। চুনোপুঁটিরাই প্রথম, চুনোপুঁটিরাই শেষ। অর্থাৎ ২০ ডোজের বেশি চুরি হয়নি। কিন্তু এতেই কি আমরা স্বস্তি পাই? মোটেই না। আসলে স্বস্তি পাই না এই জন্য- যেহেতু টিকা কোনো গাছে ঝুলে থাকা আম বা লিচু নয়, হাত বাড়ালেই চুরি করা সম্ভব। টিকা চুরি মূলত একটা সংঘবদ্ধ কাজ। বিভিন্ন ধাপের কর্মীরা এর সঙ্গে জড়িত না থাকলে কোনোভাবেই এটা সম্ভব হতো না। আর এই যে জড়িত থাকা বা জড়িত হওয়ার বিষয়টা- এটা স্বল্পসময়ের কাজ না। এর মানে, দীর্ঘ সময় নিয়ে এর পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। অবশেষে করা হয়েছে বাস্তবায়ন। আর এমন পরিকল্পনা সাধারণ কম স্বার্থের বিনিময়ে করা হয় না। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি- এক হাজার টাকা পাওয়ার লোভে কেউ দশ দিন সময় দেয় না। বড়জোর একদিন, দুই দিন বা তিন দিন দিতে পারে। এর মানে, কেবল ২০ ডোজ টিকা চুরি জন্য এত ধাপ পার করে কাজটা সম্পন্ন করা হয়েছে- এটা অবাস্তব। যদি আপাতত আর কোনো ‘সংখ্যা’ বের না হয়, তা হলেও আমরা ধরে নিতেই পারি- ভবিষ্যতে বের হতো। অর্থাৎ ভবিষ্যতে আরও বেশিসংখ্যক টিকা চুরি করার প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে চুরি করা হয়েছিল এই ২০ ডোজ টিকা। অস্বীকার করার কোনো জো নেই, এই প্রস্তুতি বা পরিকল্পনাটি লোমহর্ষক একটি পরিকল্পনা। কেন লোমহর্ষক, এর ব্যাখ্যা দেওয়া যাক।
টিকা প্যারাসিটামলের মতো সাধারণ কোনো ওষুধ নয়- যেটা ঘরে রেখে দেওয়া যায়; যখন খুশি, তখন খাওয়া যায়। টিকা উৎপাদিত হয় দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ব্যবহারের ক্ষেত্রেই অনুসরণ করতে হয় ঠিক একই রকম প্রক্রিয়া- নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বহন করা, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রয়োগ করা ইত্যাদি। কিন্তু যারা চুরি করেছে, তারা ‘প্রক্রিয়া’ ঠিকমতো অনুসরণ করবে না- এটাই স্বাভাবিক। আর এটা সম্ভবও নয়। এর মানে, চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় যদি তাপমাত্রার কথা ভাবা না হয় অর্থাৎ সঠিক তাপমাত্রায় নেওয়া না হয়, তা হলে পথেই টিকা অকেজো হয়ে যাবে। তার পর আসে সংরক্ষণের প্রসঙ্গ। পথে অকেজো হয়ে যাওয়া টিকা যত যত্নসহকারেই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, সেটি আর কোনো উপকারে আসবে না। নষ্ট ডিম যত যত্ন নিয়েই তা দেওয়া হোক, সেটি ফোটে না। হ্যাঁ, যদি সৌভাগ্যবশত পথে টিকা অকেজো না হয় অর্থাৎ যদি সঠিক তাপমাত্রায় বহন করা হয়, তা হলেই যে শেষরক্ষা হয়ে গেল- এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। কারণ সংরক্ষণের বিষয়টি তখনো বাকি থাকে। চুরির জিনিস কেউ খুব যতেœ রাখতে পারে না ধরা পড়ার ভয়ে। হয় মাটির নিচে পুঁতে রাখে, না হয় এমন কোনো জায়গায় রাখে- যেখানে লোকজনের যাতায়াত নেই। চুরি করা টিকা হয়তো মাটির নিচে কেউ পুঁতবে না। তবে খুব যে প্রকাশ্যে ও সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করবে, তাও নয়। এর মানে, আনার পথে অকেজো না হলে সঠিক উপায়ে সংরক্ষণের অভাবে অকেজো হতেই পারে। আর অকেজো হলেও সেটি বোঝার ক্ষমতা চোরদের থাকার কথা নয়। যদি থাকে, তা হলে তারা কারও কাছে প্রকাশ করবে না। বরং ‘শতভাগ ভালো আছে’ বলেই তারা অন্যের কাছে বিক্রি করবে, অন্যের শরীরে প্রয়োগ করবে। আবারও ওই ডিমের প্রসঙ্গ। নষ্ট ডিম খেলে যেমন পেটে সমস্যা হয়, নষ্ট বা অকেজো টিকা শরীরে নিলে শরীর খারাপ হবে- এটাই বাস্তবতা। আর এই শরীর খারাপের শেষ কোথায়, সেটি আমাদের জানা নেই। যদি বলা হয় শেষ গন্তব্য মৃত্যু, তা হলে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। কারণ তরতাজা টিকাও অনেকের শারীরিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর অকেজো টিকা সমস্যার কারণ হয়ে কেন দাঁড়াবে না? আর ওই সমস্যা বাড়তে বাড়তে কেন মৃত্যুতে গিয়ে ঠেকবে না?
যারা ২০ ডোজ টিকা চুরি করেছে, তারা যদি টাকার অঙ্ক হিসেব করত- তা হলে দেখত অঙ্কটা খুব ছোট। এই ছোট অঙ্ক কীভাবে বড় করা যায়, হয়তো শুরু করে দিত ওই প্রচেষ্টা। এর মানে, এক টিকা থেকে কীভাবে ১০ টিকা বানানো যায়- ওই অপচেষ্টা। টিকার সঙ্গে পানি বা এই জাতীয় অন্য কোনো উপাদান মেশাত। হয়তো চোরচক্রটি এখন ধরা পড়েছে। তাই তারা কী করতে পারত, সেটি নিয়ে চিন্তা করাটাকে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। আসলে অযৌক্তিক নয়। কারণ ভবিষ্যতেও কেউ না কেউ এই চুরির পথে হাঁটতে পারে। তখন অধিক লাভবান হওয়ার লোভে এক লিটার দুধকে পানি মিশিয়ে যেমন তিন লিটার বানানো হয়, তেমনি ১০টা টিকাকে বানানো হবে ১০০টা। আর সেসব টিকা উপকারে আসবে না- এটাই সত্য। এই ‘সত্য’ একদম মিথ্যা বানিয়ে দিতে পারে বিজ্ঞানীদের যাবতীয় অর্জনকে। অর্থাৎ ওই সব নকল টিকা মানুষের শরীরে নেওয়ার পর যখন কোনো কাজে আসবে না, তখন আস্তে আস্তে বিশ^াস উঠে যেতে শুরু করবে টিকার ওপর থেকে। এর মানে, টিকা চুরি শুধু একটা সাধারণ চুরি নয়- বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ। ওই ক্ষতি আমাদের বিশ^াস নষ্ট করে, এক ফুৎকারে নিভিয়ে দেয় করোনা নামের অন্ধকার জয়ের আলোর প্রদীপকে।
ইকবাল খন্দকার : কথাসাহিত্যিক ও টিভি উপস্থাপক