বৃটেনের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ। দুই দেশের সম্পর্কের প্রায় সব বিষয় নিয়ে কথা হবে ৯ই সেপ্টেম্বরের লন্ডন বৈঠকে। বাংলাদেশ ও বৃটেনের মধ্যকার বাৎসরিক পর্যালোচনা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক ‘এমওইউ ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’-এর আওতায় হবে ওই বৈঠক। ঢাকা ও লন্ডনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অত্যাসন্ন
বৈঠকে ব্রেক্সিট পরবর্তী বৃটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? তার একটি পথনকশা বা রূপরেখা তৈরিতে জোর দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বৃটেনের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। যুদ্ধ-বন্ধু বৃটেন স্বাধীনতার পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে চলেছে। ইউরোপে জার্মানির পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস বৃটেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশটিতে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যার বেশির ভাগ তৈরি পোশাক।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বহু বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে বৃটেনে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়ে আসছে। কিন্তু গত ক’বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। এসব বিষয়ে বৃটিশ সরকারের বিভিন্ন মন্তব্য বা রিপোর্টে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। অতি সম্প্রতি বৃটেনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করে সতর্ক করা হয়েছে। বৃটেনের তরফে অবশ্য এ নিয়ে কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। বৃটেন মনে করে স্পর্শকাতর এসব বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া রয়েছে। তারা এটাকে ‘এনডিউরিং রিলেশনশিপ’ বলে বরাবরই আখ্যায়িত করে। বৃটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের নোট মতে, ‘অভিন্ন লক্ষ্য এবং মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ও বৃটেনের আজকের এই স্থায়ী সম্পর্ক’। সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করেন, যেকোনো সম্পর্ক যত মধুরই হোক না কেন তাতে উত্থান-পতন বা টানাপড়েন থাকতেই পারে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, রাষ্ট্রগুলোর বন্ধুত্বে ‘স্বার্থ’ থাকে নিয়ামক ভূমিকায়। ফলে টানাপড়েন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এটা যেন তিক্ততার পর্যায়ে না যায় এজন্য আলোচনার দ্বার সবসময় উন্মুক্ত থাকে। এক কর্মকর্তা বলেন, বৃটিশ ফরেন অফিস প্রকাশিত বৈশ্বিক মানবাধিকার রিপোর্টের ‘আপত্তিকর’ অংশের প্রতিবাদ করেছে ঢাকা। ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছে, এটা সত্য। এতে তারা রুষ্ট হতে পারেন। কিন্তু আলাপ-আলোচনা বন্ধ নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের তাসখন্দ সফর কালে বৃটেনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। দু’দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডন সফর করেছেন। সেখানে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠকের অ্যাপয়েনমেন্ট ছিল। কিন্তু দোহায় আফগান বিষয়ক বৈঠকে যোগদান করতে যাওয়ায় সেই বৈঠকটি স্থগিত করতে হয়েছে। বৃটিশ মন্ত্রী এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে পরবর্তীতে উভয়ের সুবিধাজনক সময়ে বৈঠকে বসার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কর্মকর্তারা বলেন, এখন হয়তো খুব তাড়িতাড়ি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকটি হবে না। তবে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকটি হচ্ছে। ৯ই সেপ্টেম্বরের বৈঠকে মোটাদাগে রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতা এবং বর্তমান আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিস্তৃত আলোচনা হবে। সেখানে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির বিষয়েও কথা হবে। উল্লেখ্য, গত ১লা জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে বৃটেন। এর ফলে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক তথা রাজনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো কেমন হবে? তা জানতে ঢাকায় ব্যাপক আগ্রহ এবং উদ্বেগ রয়েছে। সেই বিবেচনায় আসন্ন বৈঠকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন- ব্রেক্সিটের পর বৃটেনে বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে হয়তো এখনই কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের কাতার থেকে বেরিয়ে গেলেও যেন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তেমন হেরফের না হয়, সে বিষয়ে এখনই বোঝাপড়া করতে হবে। বিশেষ করে ’২৪ এর পর বৃটেনে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকবে কিনা? এবং ’২৭-এর পর ইইউ’র জিএসপি প্লাস সুবিধা বাংলাদেশ পাবে কি না? তা নিশ্চিত হতে হবে এখনই। স্মরণ করা যায়, ২০১৭ সাল থেকে বৃটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। ওই বছরে স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ বিষয়ক সমঝোতা হয় এবং এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে বাৎসরিক ওই পর্যালোচনা বৈঠক হয়েছে। তিনটি বৈঠকেই সম্পর্কের অনেক জটিল ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে। সমাধানের পথও বেরিয়েছে। বৃটেনের ভিসা নিয়ে ভোগান্তি-জটিলতা, বৃটেনে ইইউ’র আদলে বাংলাদেশি পণ্যের বিশেষ বাজার সুবিধা, দেশে বৃটিশ বিনিয়োগ বাড়ানো, বাংলাদেশের ওপর বড় বোঝা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং বৃটেনে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের দ্রুত ফিরিয়ে আনাসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে সেই সব বৈঠকে কথা হয়। এভিয়েশন সিকিউরিটি ও সন্ত্রাসবাদের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়েও তাতে আলোচনা হয়েছিল। ২০২০ সালে লন্ডনে চতুর্থ সংলাপ বা রাজনৈতিক আলোচনা হওয়ার ঘোষণা ছিল ২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতায় সেই আয়োজন সম্ভব হয়নি। দেড় বছর স্থগিত থাকা সেই বৈঠকেই বসছেন দুই দেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। লন্ডনের সেই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন আর লন্ডনের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকছেন দেশটির পার্মান্যান্ট আন্ডার সেক্রেটারি ও হেড অব ডিপ্লোমেটিক সার্ভিস ফিলিপ বার্টন।