মানুষের দেখার জন্য চোখের কর্নিয়া ও লেন্স খুবই প্রয়োজনীয়। চোখের স্বচ্ছ লেন্স বয়সজনিত বা অন্য কোনো কারণে অস্বচ্ছ হলে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হয়। চোখের লেন্স অস্বচ্ছ হওয়ার নাম ছানি। বয়স বাড়লে, আঘাত লাগলে, চোখে অন্য কোনো প্রদাহ হলে, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ হলে, দীর্ঘদিন চোখে ড্রপ দিলে চোখে ছানি পড়ে। ছানি তিন ধরনের হয়- নিউক্লিয়ার, কর্টিক্যাল ও সাব ক্যাপসুলার।
ছানির চিকিৎসা : ছানির একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন। ওষুধ কিংবা চশমা দিয়ে ছানির চিকিৎসা সম্ভব নয়। ছানি অপারেশনে চোখের ভেতরের অস্বচ্ছ লেন্স বের করে তার জায়গায় কৃত্রিম লেন্স বসানো হয়। ছানির অপারেশন বিভিন্নভাবে করা হয়। যেমন- ফ্যাকো সার্জারি (সেলাইবিহীন ছানি অপারেশন) ও প্রচলিত ছানি অপারেশন (সেলাইযুক্ত)। ছানির চিকিৎসা না করলে দৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। বেশি দেরি করলে গুকোমা বা চোখের প্রেসার, চোখে প্রদাহ ও তীব্র ব্যথাসহ পুরোপুরি অন্ধ হওয়ার মতো মারাত্মক জটিলতা বয়ে আনতে পারে।
ফ্যাকো সার্জারি : ছানিকে গলিয়ে বের করে চোখে কৃত্রিম লেন্স বসানো হয়। ফ্যাকো সার্জারি চালু হওয়ায় ছানি অপারেশনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এটা যদি আমরা তুলনামূলক বিচার করি তা হলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ফ্যাকো অপারেশন- এখানে লেন্সকে গলিয়ে বের করা হয়। এ পদ্ধতিতে রক্তক্ষরণ হয় না। ২.৫-৩ মিমি. ছিদ্র করা হয়। সেলাইবিহীন। অপারেশনের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি যাওয়া যায়। এ অপারেশনে শুধু ৭ দিন চোখে পানি দেওয়া নিষেধ। দ্রুত সেরে ওঠে।
প্রচলিত অপারেশন : এ অপারেশনে পুরো লেন্স একবারে বের করে আনা হয়। এখানে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। এ অপারেশনে ৬-৭ মিমি. ছিদ্র করা হয়। এ পদ্ধতিতে মাঝে মাঝে সেলাই লাগে। অপারেশনের পর অন্তত ১ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। তবে যে কোনো পদ্ধতিতে ছানি অপারেশনের পর কাছে দেখার জন্য চশমার প্রয়োজন হয়। তবে মাল্টি ফোকাল লেন্স ফ্যাকো সার্জারিতে ব্যবহার করলে দূরে-কাছে কোথাও চশমা লাগে না।
ফ্যাকো সার্জারির সুবিধা : সেলাইবিহীন; দ্রুত সেরে ওঠে; ৩-৪ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারা, এর মধ্যে- গাড়ি চালানো, লেখাপড়া করা, টিভি দেখা, অফিস করা; অপারেশনের কিছু সময় আগে ভর্তি হওয়া; অপারেশনের পর বাসায় চলে যাওয়া; ঝঁৎভধপব/খড়পধষ অহধবংঃযবংরধ-এর মাধ্যমে অপারেশন করা হয়; যেসব রোগী সহযোগিতা করতে পারেন তাদের ইনজেকশন না দিয়ে শুধু ড্রপের মাধ্যমে অপারেশন করা হয়; ইনজেকশন না দিলে এবং ডাক্তার উপযুক্ত মনে করলে অপারেশনের পর চোখে ব্যান্ডেজ না দিয়ে বাড়ি পাঠাতে পারেন; জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে এবং অপারেশনের পর পরই স্বাভাবিক খাবার খেতে পারবেন।
অপারেশন করতে করণীয় : আমরা চক্ষু বিশেষজ্ঞরা অপারেশন করার উপদেশ দিলে, পরামর্শমতো অপারেশনের আগে ৩-৪টি বিভিন্ন পরীক্ষা করতে হবে। যেমন- ডায়াবেটিসের জন্য ব্লাড সুগার; ইসিজি; চোখে যে লেন্স বসানো হবে তার মাপের জন্য বায়োমেট্রিক; চোখের প্রেসার পরীক্ষা ও করোনাকালীন করোনার টেস্ট করা।
ফোল্ডেবল লেন্স : এই লেন্স, লেন্সের সর্বশেষ সংস্করণ। এই লেন্স নরম এবং ভাঁজ করা যায়। এই লেন্সের ক্ষেত্রে মাত্র ২.৫-৩ মিমি. কাটতে হয়। এ ক্ষেত্রে অপারেশনের পর লেন্সের পেছনে অস্বচ্ছ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এ ক্ষেত্রে চোখ অতি দ্রুত সেরে ওঠে।
সাধারণ লেন্স : ঝওঈঝ পদ্ধতিতে- সাধারণ প্রচলিত লেন্স (চগগঅ); এই লেন্স শক্ত, ভাঁজ করা যায় না; এই লেন্সের ক্ষেত্রে ৫.৫ মিমি. কাটতে হয়; এ ক্ষেত্রে অপারেশনের পর লেন্স অস্বছ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমে অবশ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে স্বল্পপরিমাণ রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমে অহধবংঃযবংরধ দিতে হয়।
অপারেশন-পরবর্তী করণীয় : অপারেশনের পর ডাক্তারের কাছ থেকে ছাড়পত্র বুঝে নিয়ে বাড়ি যেতে হয়। ছাড়পত্রে লিখিত ওষুধ নিয়মমাফিক ব্যবহার করা। ৭ দিন চোখে সরাসরি পানি না লাগানো। অপারেশনের পরের দিন, ৭ দিন পর এবং এক মাস পর মোট তিনবার ডাক্তারের কাছে আসতে হবে। এর মধ্যে যে কোনো সময় কোনো অসুবিধা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। ছানি হলেই যদি কারও স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হয়, সে ক্ষেত্রে ছানি পোক্ত হওয়ার জন্য দেরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক সময় ছানি না হলেও ১০-১২ বা ততোধিক চোখের মাইনাস পাওয়ার হলে স্বচ্ছ লেন্সেও ফ্যাকো সার্জারি।
লেখক : উপাচার্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়