প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা দিতে সিনেটে অভিশংসন বিচারকাজ শুরুর আগেই ভোটের ডাক দিতে পারেন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল। দুজন সিনেটরকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এ কথা জানিয়েছে। সিনেটে রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ সিনেটর মনে করেন, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ ধরনের বিতর্কিত একটি বিষয়কে বিচারের মুখোমুখি না করেই খারিজ করে দেওয়াটা অনুচিত হবে। সিনেটের ১০০টি ভোটের মধ্যে ৫১টি ভোটের জোরে মিচ ম্যাককনেল ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত চূড়ান্ত অভিশংসন তদন্ত প্রতিবেদনটি হয়তো খারিজ করতে পারবেন, কিন্তু তা আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের জন্য ভালো কিছু আনবে না বলে মনে করছেন অনেক সিনেটর।
অনেক রিপাবলিকান সিনেটরের মতে, সিনেটে প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করে তাঁকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে ৬৭ ভোটের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে এতসংখ্যক ভোট ডেমোক্র্যাটরা দলে ভেড়াতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে বিচারকাজের জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। তবে এ ক্ষেত্রে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স কিন্তু ভোট দিতে পারবেন না। স্বার্থের দ্বন্দ্বের দরুন নিয়ম অনুযায়ী তিনি ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া ছাড়া। সিনেটে অভিশংসন শুনানিতে সভাপতিত্ব করবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। রিপাবলিকান সিনেটরদের আরেকটি পক্ষ মনে করেন, প্রেসিডেন্টকে পুরো সাফসুতরো করার জন্য একটি ভোটগ্রহণ করা যেতে পারে, যা প্রেসিডেন্টকে শুধু আনীত অভিযোগগুলোই নয়, সব দিক থেকেই নির্দোষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এ ক্ষেত্রে মিচ ম্যাককনেল শুরুতেই একটি সাধারণ ভোটের আহ্বান জানাতে পারেন, যার মূল কথাই থাকবে অভিশংসন তদন্ত প্রতিবেদনকে খারিজ করা। তবে ৫১টি ভোটের নিশ্চয়তা না পেলে ম্যাককনেল এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না বলেই মনে করে একটি সূত্র।
শুরুতেই নির্দোষ প্রমাণে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে টেক্সাস থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর জন করনিন বলেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়। বরং অভিশংসন প্রতিবেদনের ওপর ভোট আগে গ্রহণ করা উচিত। কারণ, সে ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের ৬৭টি ভোটের প্রয়োজন হবে। পরে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণে ভোট গ্রহণ করলে তা বেশি কাজে দেবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় মিচ ম্যাককনেলের হাতে এ বিকল্পটি থাকছে। তাঁর মতে, অভিশংসন প্রস্তাবটি সিনেটে উত্থাপনের পর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিনিধি পরিষদের প্রতিনিধি ও প্রেসিডেন্টের পক্ষের আইনজীবীরা প্রারম্ভিক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। এর পরপরই চাইলে সরাসরি বিচারকাজ শুরু করা যায়। অথবা এই পর্যায়েই অভিশংসন প্রতিবেদনটি খারিজ করে দিতে একটি ভোট আহ্বান করা যায়। তবে ঠিক করা হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এদিকে আগামী সপ্তাহেই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর ভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে প্রতিনিধি পরিষদে। সেখানে এ প্রতিবেদনের পক্ষে ডেমোক্র্যাটদের ঐকমত্য রয়েছে বলা যায়। ওই প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে বাধাÍএ দুটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। এ বিষয়ে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জেরল্ড ন্যাডলার ১০ ডিসেম্বর ক্যাপিটল হিলে প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট যদি প্রথমে তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং তারপর কংগ্রেসের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে আসা অনুরোধগুলো খারিজ করতে একটি পাথরের দেয়াল তৈরি করে বসেন, তবে কংগ্রেসের পক্ষে তার দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে ওঠে। নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটি এতে একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে, যার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠেন একনায়ক।’
তবে এই প্রতিবেদন সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছেন কমিটির রিপাবলিকান প্রতিনিধি ডাউ কলিনস। তিনি ডেমোক্র্যাটদের পূর্বসিদ্ধান্ত দ্বারা চালিত হয়ে অভিশংসন প্রতিবেদন তৈরির জন্য অভিযুক্ত করেন। তাঁর মতে, প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে সংযুক্ত প্রমাণাদি সংগতিপূর্ণ নয়।
এদিকে ১১ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছেন। একটি সূত্রের উল্লেখ করে রয়টার্স জানায়, বৈঠকে সিনেটে অভিশংসন বিচারকাজ সংক্ষিপ্ত করে আনার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। শুরুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পূর্ণাঙ্গ ও দীর্ঘসূত্রী বিচারকাজের প্রতি আগ্রহ দেখালেও এখন সে অবস্থান থেকে তিনি সরে এসেছেন।
সিনেটে অভিশংসন বিচার শুরু হলে জো বাইডেন ও তাঁর ছেলেকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হতে পারে বলে এর আগে হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এখনো তিনি সে অবস্থানে রয়েছেন কিনা, তা জানা যায়নি। তবে এমন কোনো পদক্ষেপে আগ্রহী নন রিপাবলিকান শীর্ষ নেতারা। কারণ, বাইডেনদের শুনানিতে ডাকা হলে, ডেমোক্র্যাটরাও ট্রাম্পের শীর্ষ উপদেষ্টা ও প্রশাসকদের শুনানিতে ডাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পুরো প্রশাসনকেই ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনেন ডেমোক্র্যাটরা। ওই দিন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রকাশিত আর্টিকেল অব ইমপিচমেন্টে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ইউক্রেন তদন্ত নিয়ে কংগ্রেসের কাজে বাধা সৃষ্টিকে মূল অভিযোগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিশংসনের মুখোমুখি হলেন ট্রাম্প।
এ সম্পর্কিত সংবাদ সম্মেলনে জেরল্ড ন্যাডলার বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার সংবিধানকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। একই সঙ্গে ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ফেলেছেন হুমকির মুখে। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তাকেও সংকটে ফেলেছেন তিনি। ন্যাডলার বলেন, ‘কেউ, এমনকি প্রেসিডেন্টও আইনের ঊর্ধ্বে নন।’ আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে সম্ভাব্য এ প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে চাপ প্রয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ জন্য ট্রাম্প ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত সামরিক সহায়তা তহবিলও আটকে দেন। এ পরিপ্রেক্ষিতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিষয়টি নিয়ে অভিশংসন তদন্তের ঘোষণা দেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। পরে অভিশংসন তদন্তের প্রক্রিয়া নির্ধারণে কংগ্রেসে ভোট হয়। সেখানে ডেমোক্র্যাটদের প্রস্তাব পাস হলে, দুই সপ্তাহ উন্মুক্ত শুনানি গ্রহণ করে হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটি। এই পর্যায়েই হোয়াইট হাউসের কর্তাব্যক্তিদের অনেককে শুনানিতে হাজির হওয়ার শমন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্টের নির্দেশে হোয়াইট হাউস এতে পুরোপুরি অসহযোগিতা করে। হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয় হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে, যা আজ প্রকাশ করা হলো।
প্রকাশিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচার ব্যবস্থাপক ব্র্যাড পার্সক্যাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অভিশংসন প্রস্তাব ডেমোক্রেটিক দলের একটি রাজনৈতিক নাটক। আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে তাদের কোনো ভালো প্রার্থী নেই বলেই এমন নাটক সাজানো হচ্ছে।’ উল্লেখ্য, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ১৮৬৯ সালে অ্যান্ড্রু জনসন, ১৯৭৪ সালে রিচার্ড নিক্সন ও ১৯৯৮ সালে বিল ক্লিনটন অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে রিচার্ড নিক্সন অভিশংসিত হতে পারেন বুঝতে পেরে আগেই পদত্যাগ করায় পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়নি। এ পর্যন্ত চারজন প্রেসিডেন্ট অভিশংসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্টই অভিশংসিত হননি।