মস্তিষ্কের কোনো অংশে অস্বাভাবিক পিণ্ড বা কোষ জমাট বাঁধার নামই হলো ব্রেইন টিউমার। মানুষের মাথার খুলির ভেতর একটি নির্দিষ্ট আকৃতির মধ্যে সুরক্ষিত থাকে। অস্বাভাবিক কোনো পিণ্ড বা জমাটবদ্ধ কোষ (টিউমার) বেড়ে গেলে, তা মস্তিষ্কের ওপর চাপ তৈরি করে মস্তিষ্কের কার্যক্রমে ব্যাঘ্যাত ঘটায়। সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে। ব্রেইন টিউমার মূলত দুই প্রকার। এর একটি হলো প্রাইমারি ব্রেইন টিউমার। যে ব্রেইন টিউমার সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন হয়, তার নাম প্রাইমারি ব্রেইন টিউমার। যেসব স্থানে এ ধরনের টিউমার হতে পারে তা হলো- মস্তিষ্কের কোষ, মস্তিষ্কের আবরণী পর্দা (মেনিনজেস), স্নায়ুকোষ এবং গ্রন্থি। সেকেন্ডারি ব্রেইন টিউমারের ক্ষেত্রে শরীরের অন্য স্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে মস্তিকে সংক্রমণ ঘটায়। মূলত অন্য স্থানের ক্যানসার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লে এ ধরনের ব্রেইন টিউমার হয়। যেসব ক্যানসার থেকে এ ধরনের ব্রেইন টিউমার হয় তা হলো- ফুসফুসের ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসার, কিডনির ক্যানসার, ত্বকের ক্যানসার। বেশিরভাগ ব্রেইন টিউমার মূলত সেকেন্ডারি ব্রেইন টিউমার।
ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি : যে কোনো ক্যানসার বা টিউমারের ঝুঁকি বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে। তাই বয়স ৫০ বছরের বেশি হলে ব্রেইন টিউমারের কোনো একটি লক্ষণ দেখামাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করে নিতে হবে।
লক্ষণ : টিউমারের আকার ও অবস্থানের ওপর লক্ষণ নির্ভর করে। কিছু টিউমার সরাসরি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে আর কিছু মস্তিষ্কের ওপর চাপ তৈরি করে মস্তিষ্কের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। এ অবস্থায় বেশ কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। যেমনÑ মাথাব্যথা। ব্রেইন টিউমারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ এটি। ব্রেইন টিউমারজনিত মাথাব্যথার কিছু বৈশিষ্ট্য হলো- মাথাব্যথা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সবচেয়ে বেশি তীব্র থাকে। ঘুমের মধ্যে মাথাব্যথা শুরু হয়। ফলে ঘুম ভেঙে যায়। হাঁচি, কাশি ও ব্যায়ামের সময় মাথাব্যথা অনুভূত হয়। এ ছাড়া বমি হওয়া, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, বিভ্রান্তি, খিঁচুনি, শরীর বা মুখমণ্ডলের কোনো অংশে দুর্বলতা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, স্মৃতিশক্তি লোপ, খাবার গিলতে এবং হাঁটায় সমস্যা হওয়া।
রোগ নির্ণয় : বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরীক্ষা ও পআগে কী ধরনের চিকিৎসা পেয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে ব্রেইন টিউমার নির্ণয় করা হয়। শারীরিক পরীক্ষার মধ্যে অন্যতম হলোÑ নিউরোজিক্যাল পরীক্ষা। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখেন, রোগীর মস্তিষ্কের স্নায়ু ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। এ ছাড়া ডাক্তার অফথালমোস্কোপ ব্যবহার করে চোখ পরীক্ষা করে থাকেন। চোখ পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেখা হয় চোখের স্নায়ুগুলো ফুলে গেছে কিনা। ব্রেইন টিউমারের ফলে মাথার খুলির ভেতর চাপ বেড়ে গেলে, তা চোখের স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে, যা এ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এর পাশাপাশি ডাক্তার আরও কিছু শারীরিক পরীক্ষা করে থাকেন। যেমন- মাংসপেশির দৃঢ়তা, স্মৃতিশক্তি, ভারসাম্য ও সমন্বয়, গাণিতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। শারীরিক পরীক্ষার পর ডাক্তার কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করিয়ে থাকেন। যেমন- সিটি স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা, এমআরআই, মাথার খুলির এক্স-রে, বায়োপসি ইত্যাদি। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেইন টিউমার নিশ্চিত হওয়া যায়।
চিকিৎসা : ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা নির্ভর করে টিউমারের আকৃতি, অবস্থান ও ধরনের ওপর।
সার্জারি : নিউরোসার্জারির মাধ্যমে সম্পূর্ণ টিউমার, কিংবা টিউমারের কিছু অংশ অপসারণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই টিউমার মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আকার বেড়ে যাওয়ায় মাথার খুলির ওপর চাপ ফেলে। কিছু টিউমার আছে, যা মস্তিষ্কের মধ্যে এমনভাবে বিস্তারিত হয়ে যায়, তা সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে টিউমারের ধরন ও আকারের ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য চিকিৎসা করা হয়।
তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা : রেডিওথেরাপি নামে পরিচিত নির্দিষ্ট মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে টিউমার কোষ ধ্বংস করা হয়। অনেক সময় সার্জারিতে সম্পূর্ণ টিউমার অপসারণ করা যায় না। তখন সার্জারির পর বাকি অংশ অপসারণ বা ধ্বংস করতে রেডিওথেরাপি ব্যবহার করা হয়।
কেমোথেরাপি : ওষুধ ব্যবহার করে ব্রেইন টিউমারের যে চিকিৎসা করা হয়, তা কেমোথেরাপি নামে পরিচিত। এ ওষুধ রক্তনালির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে টিউমার কোষ ধ্বংস করতে সাহায্য করে। এগুলো ট্যাবলেট, ক্যাপসুল অথবা ইঞ্জেকশন হতে পারে। কেমোথেরাপির ফলে বমি, মাথা ঘোরানো, ক্ষুধামান্দা, ক্লান্তিসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সবশেষ কথা হলো, ব্রেইন টিউমার মারাত্মক একটি রোগ। কোনো লক্ষণ দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল