মিরপুরের শ্যামলী এলাকায় অবস্থিত উত্তরা মটরস এর ডিলার ইডেন আটোস নামক শোরুমে ডাকাত দল প্রবেশ করে ম্যানেজার ওয়াদুদ সজীব এবং মোটর টেকনিশিয়ান নুরনবী হাসানকে ধারালো চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। এ সময় ডাকাত দলের কিছু সদস্য শোরুমের দোতলায় উঠে গ্লাস, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং ক্যাশ ড্রয়ার ইত্যাদি ভাঙচুর করে এবং ক্যাশ হতে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ডেস্কটপ মনিটর নিয়ে পালিয়ে যায়। গত ১২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঘটনাটি ঘটে।
এই ঘটনার পরের দিন শোরুমের মালিকের পক্ষ হতে কে এম আবদুল খালেক শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবারে রাতে র্যাব সদর দপ্তর গোয়ন্দা শাখা ও র্যাব-২ ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এবং ধামরাই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ডাকাত চক্রের মূলহোতা মো. জহিরুল ইসলাম ওরফে জহিরসহ ডাকাত চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় লুন্ঠিত অর্থ ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্র ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করা হয়।
আজ রোববার কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং-এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- মো. জসিম উদ্দিন (৩৪), মো. জাহিদুল ইসলাম শিকদার (২৬), মো. খায়রুল ভূঁইয়া (২০), মো. রাকিব হাসান (২০) মো. নয়ন (২৮)।
অভিযানে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত চারটি চাপাতি, শোরুম থেকে লুন্ঠিত এক লাখ ৯৩ হাজার টাকা উদ্ধার এবং ডাকাতিকালে তাদের পরিহিত দুটি গেঞ্জি এবং একটি লুঙ্গি জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা মোহাম্মদপুর কেন্দ্রিক একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য, যার সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। তারা সকলেই এই এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে এবং এই সূত্রে পরস্পরের পরিচিত। এই চক্রটি ঢাকার মোহাম্মদপুর, বসিলা, শ্যামলী এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে বিগত কয়েক বছর যাবৎ এলাকার ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নির্মাণাধীন ভবন মালিকদের নিকট চাঁদাবাজি করে আসছে।
দাবিকৃত চাঁদা না দিলে তারা ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। তারপরেও কেউ চাঁদা দিতে অসম্মত হলে তারা ভুক্তভোগীদের বাড়ি অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ডাকাতি করে থাকে। তাদের নামে একাধিক চুরি, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তারা এলাকায় মাদক ও চোরাই অটোরিকশার ব্যবসা, চুরি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
যেভাবে ডাকাতি
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, বেশ কয়েক মাস যাবৎ একজন পলাতক তথাকথিত সন্ত্রাসীর নামে ইডেন অটোস নামক প্রতিষ্ঠানটিতে চাঁদা দাবি করে আসছে। চাঁদা প্রদান না করলে বিভিন্ন রকম হুমকি প্রদান করে। এই চক্রের সদস্যরা হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদা আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটিতে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করে।
১১ অক্টোবর তারা ঢাকা উদ্যান এলাকায় গ্রেপ্তার জসিমের আবাসস্থলে জহির, জাহিদ, নয়ন, খায়রুল এবং রাকিব একত্রিত হয়ে শ্যামলী ইডেন অটোস শোরুম ডাকাতি করার বিস্তারিত পরিকল্পনা করে। অতঃপর ওইদিন সন্ধ্যায় ওই শোরুম তারা অনুসন্ধান করে। জসিম এবং জহির ঢাকা উদ্যান কাঁচাবাজার হতে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত চারটি চাপাতি ক্রয় করে।
ঘটনার দিন পুনরায় ঢাকা উদ্যানে জড়ো হয়ে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, শোরুমের সামনে আসে এবং শোরুমের লোকজন ও আশে পাশের লোকজনদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। অতঃপর জাহিদ তার নিকট রক্ষিত ব্যাগ হতে তিনটি চাপাতি জহির, রাকিব এবং খায়রুলের হাতে দেয় এবং নিজে একটি চাপাতি নিয়ে নয়নসহ একযোগে শোরুমে প্রবেশ করে।
এ সময় জসিম শোরুমের বাইরে অবস্থান করে ওয়াচম্যান হিসেবে কাজ করে। জহির শোরুমে প্রবেশ করেই ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে ম্যানেজার সবুজকে আঘাত করে এবং রাকিব চাপাতি দিয়ে শোরুমের মোটর টেকনিশিয়ান হাসানকে আঘাত করে। এই সময় দলের অন্য সদস্যরা শোরুমে ভাঙচুর করে। শোরুমের ২য় তলায় গিয়ে কাঁচের দরজা ভেঙ্গে ক্যাশিয়ারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ক্যাশ বাক্স হইতে নগদ অর্থ লুট করে। খায়রুল শোরুম থেকে একটি পুরাতন ডেস্কটপের মনিটর নিয়ে নেয়। গ্রেপ্তারকৃতরা ৫-৬ মিনিটের ডাকাতি সম্পন্ন করে বের হয়ে যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও জানায়, শোরুম থেকে বের হয়ে জহির এবং জাহিদ লেকসিটি’তে জাহিদের বাসায় টাকা নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে স্ব স্ব ভাগের টাকা নিয়ে সকলে আত্মগোপনে চলে যায়।
র্যাব জানায়, জহিরুল ইসলাম ওরফে জহির চক্রের মূলহোতা। সে জসিম ও অন্যান্যদের সহযোগিতা নিয়ে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও নির্মাণধীন বিল্ডিং হতে টাকা দাবিসহ নানাবিদ অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত। মোটরসাইকেল শোরুমে ডাকাতির সময় তার নেতৃত্বে অন্যান্য সহযোগীসহ ডাকাতি সম্পন্ন করে। শোরুমে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সে ম্যানেজার ওয়াদুদ সজীবকে চাপাতি দিয়ে বাম পায়ে আঘাত করে। সে পূর্বে অটোরিকশা চালালেও বর্তমানে চোরাই অটোরিকশার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানায়। তার নামে একটি ডাকাতি মামলা এবং মোহাম্মদপুর থানায় একাধিক ছিনতাইয়ের মামলা ও অভিযোগ রয়েছে।
জসিম এই চক্রের সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। মোটরসাইকেল শোরুমে ডাকাতির সময় সকলকে একত্রে করা এবং ডাকাতি চলাকালীন শোরুমের বাইরে অবস্থান করে; সে ওয়াচম্যানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। সে ঢাকা উদ্যানে অবস্থিত একটি হাউজিং এ পিয়নের চাকরির অন্তরালে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তার বিরুদ্ধেও মোহাম্মদপুর থানায় একটি চাঁদাবাজি এবং জমি দখল এর মামলা রয়েছে।
র্যাবের সূত্র জানায়, মো. রাকিব হাসান এই চক্রের সমন্বয়কারী জসিমের নিকট আত্মীয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায় যে ডাকাতিকালে মোটরসাইকেল টেকনিশিয়ান হাসানকে সে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। দলের অন্যান্য সদস্যদের ন্যায় সে নানাবিধ অবৈধ কাজে জড়িত। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় চুরি এবং ছিনতাইয়ের অভিযোগে দুটি মামলা রয়েছে।