ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে এখন বিতর্কের বোঝা। একের পর এক ইউপিতে দল মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে উঠছে বিভিন্ন অভিযোগ। ইউনিয়নে ইউনিয়নে হচ্ছে মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ এমনকি দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে জমা পড়ছে অভিযোগপত্র। ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পর আওয়ামী লীগ এখন কাজ করছে তৃতীয় ধাপের বাছাই নিয়ে। কিন্তু অসংখ্য ইউপিতে দলের তৃণমূল উত্তপ্ত হয়ে আছে ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিদের নৌকার প্রার্থী করার ক্ষোভে। এসব অভিযোগের সুষ্ঠু সমাধান না হলে দলের তৃণমূলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন অনেকে। ইতোমধ্যে নির্বাচন ঘিরে ৩ ইউপিতে ৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় রাজনীতি প্রবেশের আগের সময়ের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির গুণগত বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আগে মূলত এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন ব্যক্তিরাই প্রার্থী হতেন। কে কোন দল করে সেটি বিবেচনায় না নিয়ে এলাকাভিত্তিক বিষয়গুলো গুরুত্ব পেত বেশি। কিন্তু দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন চালুর পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। মনোনয়ন বাণিজ্য, তদবির, অর্থ, পেশিশক্তি প্রদর্শনের মতো অপরাজনীতি পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান নেতারা হয়ে পড়ছেন কোণঠাসা। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে তৃণমূলের রাজনীতির চাবিকাঠি ধীরে ধীরে বিতর্কিতদের দখলে চলে যাবে।
আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছে। গত ১০ বছর ধরেই যে কোনো নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা বেশি জয় পান। ফলে দলটি কাদের মনোনয়ন দিচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তৃণমূলে রাজনৈতিক বা সামাজিক যে কোনো বিশৃঙ্খলার দায় ক্ষমতাসীনদেরই নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ- স্বচ্ছ, জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ইউপি নির্বাচনে বিতর্কিতদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হচ্ছে। ফলে ইউনিয়নের রাজনীতিতে ভালো নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। অনেক স্থানে মনোনয়ন ঘোষণার পর প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগপত্র দাখিল, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেও খুব একটা লাভ হয়নি। অভিযোগের পর অভিযোগ এলেও খুব বেশি প্রার্থী পরিবর্তন হয়নি। এ কারণে প্রায় প্রতি ইউপিতেই বিদ্রোহী প্রার্থী দেখা যাচ্ছে। দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থী মুখোমুখি অবস্থানে থাকায় তৃণমূল বেসামাল। ইতোমধ্যে স্থানীয় নির্বাচন ঘিরে বেশ কয়েকটি জায়গায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। গত শনিবার সিলেট সদর ও ফরিদপুরের সালথা ইউনিয়নের নির্বাচনকে ঘিরে দুজনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন ৩০ জন। এর আগে চলতি মাসের শুরুতে মাগুরায় নির্বাচনী সংঘর্ষে নিহত হন চারজন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে একদিকে যেমন ভুল মানুষটির নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে তেমনি তৃণমূল থেকে না আসা সত্ত্বেও ভুল মানুুষকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তাদের ভাষ্য, কেন্দ্র ও তৃণমূল উভয় জায়গাতেই দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশ উপেক্ষিত। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, অনেক যাছাই-বাছাই করে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলও হয়েছে। সুতরাং ঢালাওভাবে এটা বলার সুযোগ নেই যে বিতর্কিতরা মনোনয়ন পেয়েছেন। অনেকে মনোনয়ন পাননি বলেই হয়তো অভিযোগ তুলেছেন। বাস্তবে এর সত্যতা নেই।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের ১নং তেলিগাতী ইউনিয়নে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন নজরুল ইসলাম খান। মনোনয়ন না পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর ফেসবুকে খোলা চিঠি লেখেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলাকারী এ নেতা উল্লেখ করেন- তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হলেও তার পরিবর্তে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী পরিবারের লোক মনোনয়ন পেয়েছে। এটি মানতে না পেরে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর দল থেকে বহিষ্কার ও হামলা-মামলার ঘটনা ঘটে।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগরের এক সময়ের শিবিরকর্মী মোয়াজ্জেম মোর্শেদ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ২০১৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে অপহরণ ও হামলার মূল হোতা মোয়াজ্জেম মোর্শেদ। তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা। যদিও মোর্শেদ নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবেই দাবি করেছেন।
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার ১নং মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া নুরুজ্জামান ভুট্টোকে ‘জামায়ত শিবিরের পৃষ্ঠপোষক, দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, কালোবাজারি’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। গত শনিবার দুপুরে ভুট্টোর প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন তারা।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বহরমপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন রেজাউল করিম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ২০১৩ সালে বহরমপুর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন।
বান্দরবানের লামার রূপসী ইউনিয়নে মনোনয়ন পাওয়া ছাচিং প্রু মার্মার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক বানানো, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম ও ধর্ষণ মামলাসহ নানা অভিযোগ আছে। তার মনোনয়নে ক্ষোভ প্রকাশ করে কেন্দ্রে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাচিং প্রু মার্মা।
ফতুল্লা থানা বিএনপির সহসভাপতি ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই বলেন, তিনি কীভাবে মনোনয়ন পেলেন, কারাই বা প্রস্তাব করল আমি কিছু জানি না। সেন্টু বিএনপি করেন কিনা জানতে চাইলে আবদুল হাই বলেন, সেন্টু শুধু বিএনপি না, সে ভূমিদস্যু ও কিলার।
বিদেশে থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শরীয়তপুরের মাহমুদপুর ইউনিয়নের শাহ আলম মুন্সী। মনোনয়ন ঘোষণাকালেও তিনি দেশে ছিলেন না। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, তৃণমূল থেকে যে তালিকা পাঠিয়েছিলাম তাতে শাহ আলম মুন্সীর নামই ছিল না।
শুধু এসব এলাকাতেই নয়, ইউনিয়ন পরিষদের মনোনয়ন পাওয়া অধিকাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ জমা হচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে।