অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব অনেক। করোনাকালে দেশের অর্থনীতি যখন স্থবির, যখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত গুরুত্বপূর্ণ সব খাত, এই সংকটের মধ্যেও প্রবাসী আয়ে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। স্থবির অর্থনীতিতে শক্তি জুগিয়েছিল সচল রেমিট্যান্স প্রবাহ। তবে চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে হঠাৎ করেই ধীরগতি দেখা যায় প্রবাসী আয়ে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকেই রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে শুরু করে। সদ্যবিদায়ী অক্টোবর মাসেও এই ধীরগতি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, অক্টোবরে দেশে ১৬৫ কোটি ডলারেরও কম রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় সাড়ে ৪ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২১ শতাংশ কম। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
করোনাকালে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়াসহ বেশকিছু কারণে রেমিট্যান্স কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় ফের হুন্ডি প্রবণতা বেড়েছে। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় কমে গেছে। এছাড়া করোনাকালে কাজ হারিয়ে দেশে চলে আসা প্রবাসীরা পুনরায় ফিরতে না পারা, করোনা ভ্যাকসিন, কোভিড টেস্ট জটিলতা এবং ভিসা ও মাইগ্রেশনসহ ফ্লাইট খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে নতুন করে মাইগ্রেট না হওয়া, বিদেশে থাকা প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়া; এসব কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে গেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে করোনা পরিস্থিতি আরও উন্নতি হলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়বে বলেও মত দিচ্ছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা মানবজমিনকে বলেন, হুন্ডি বা অবৈধ পথে যে রেমিট্যান্স আসে, করোনাকালে সেটি বন্ধ ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ বৈধ পথে আসাটা কমে গেছে। এছাড়া ট্রেড এক্টিভিটিস (বাণিজ্যিক কার্যক্রম) এখন বেড়ে গেছে। ট্রেড এক্টিভিটিস বেড়ে গেলে অনেক সময় আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং কিংবা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অবৈধ পথে লেনদেন হয়। ট্রেড এক্টিভিটিজ বাড়লে এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রমগুলো আরও বেড়ে যায়। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- যারা করোনাকালে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকেই এখন পর্যন্ত ফিরতে পারেননি। আবার এমনও ছিল যারা করোনার আগে বিদেশে যাবেন। তারাও আটকে পড়েছিল। ভিসা ও মাইগ্রেশন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং করোনা টিকা ও বিমানবন্দরে কোভিড টেস্ট জটিলতার কারণে তাদের অনেকেই এখনো যেতে পারেননি। এসব কারণে আয় কমে গেছে। আর যারা বিদেশে গেছেন, তারা তাদের কর্মক্ষেত্রে কি অবস্থায় আছেন সেটাও দেখার বিষয়। কারণ, করোনার পরে অন্য দেশের অভিবাসীরাও আসছেন। সেখানে তাদের এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে তারা কতোটা টিকে থাকতে পারছেন সেটাও দেখতে হবে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- প্রবাসীদের টাকা দেশে হুন্ডির বদলে নরমাল চ্যানেলে আসছে কিনা। সরকারকে এটি মনিটরিং করতে হবে। যেন বৈধ পথে প্রবাসী আয় দেশে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আগের সঙ্গে তুলনা করলে রেমিট্যান্স কিছুটা কম আসছে। তবে করোনার সময়ে বিভিন্ন কারণে রেমিট্যান্স বেড়েছিল। যেমন, দীর্ঘদিন করোনার কারণে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। প্রবাসীরা তাদের জমানো অর্থ পরিবার- পরিজনের নিকট পাঠিয়েছেন। তখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাগুলো দেশে এসেছে। এতে রেমিট্যান্স বেড়েছে। কিন্তু এখন সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় বিভিন্নভাবে দেশে টাকা আসছে। মানুষ যখন তখন আসছে-যাচ্ছে। তারা টাকাগুলো ব্যাংক চ্যানেলে না পাঠিয়ে নিজেরা সঙ্গে করে অন্যভাবে নিয়ে আসছে। লাগেজে করে মার্কেট করে নিয়ে আসছে। এসব কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, লকডাউন থাকায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ ছিল। ওই সময় বৈধভাবে প্রবাসীরা তাদের জমানো অর্থ দেশে পাঠানোর কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, মহামারির কারণে অনেক প্রবাসী কাজ হারিয়েছে দেশে ফেরত এসেছেন। অনেকে এখনো ফিরতে পারেননি। তাছাড়া যারা প্রবাসে আছেন তাদের আয় কমেছে, ওভারটাইম করতে পারেননি। সেজন্য আপাতত কম মনে হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি আরও কিছুটা উন্নতি হলে, ফেরত আসা সব প্রবাসীরা কাজে ফিরলে এবং নতুন করে দেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানো গেলে রেমিট্যান্সের গতি আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা যায়, সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। এরপর থেকে আর এতো কম রেমিট্যান্স আসেনি। ১৭ মাস পর ফের রেমিট্যান্স এতোটা কমেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৭০৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭৬ কোটি ৭ লাখ ডলার বা ১৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮৮১ কোটি ৫২ লাখ ডলার। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫১ কোটি ৯২ লাখ ডলার।