ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ থামার কোনো লক্ষণ নেই উত্তরপ্রদেশে। ক্রমেই তা ছড়াচ্ছে এবং সবচেয়ে জনবহুল ভারতীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। শুক্রবার রাজ্যজুড়ে চলা সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা শনিবার বেড়ে ১৬ হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে তাদের। যদিও এই দাবি উড়িয়ে রাজ্যের ডিজি ও পি সিং বলেছেন, ‘বিক্ষোভকারীদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলি চলেছে এবং তাতেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ একটি গুলিও চালায়নি। বিষয়টি ময়নাতদন্তেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ এর পাশাপাশি এদিন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাটনা, দিল্লি, চেন্নাইও।
প্রশাসন সূত্রে খবর, উত্তরপ্রদেশের মিরাট জেলায় চারজন, কানপুর ও বিজনোরে দু’জন করে, সম্ভাল এবং ফিরোজাবাদে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। বিক্ষোভকারীরা অবশ্য চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, মিরাটে যে পাঁচজন নিহত হয়েছেনন, তাদের প্রত্যেকের শরীরেই বুলেটের ক্ষত রয়েছে। নিহত ১৬ জনের মধ্যে মোহাম্মদ সাগির নামে ৮ বছরের এক বালকও রয়েছে। বারাণসীর বাজারদিহায় বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের লাঠিচার্জের সময় পালাতে গিয়ে পদপিষ্টের ঘটনায় মৃত্যু হয় তার। একটি গলিতে সে খেলছিল। যদিও ডিজির আক্ষেপ, ‘বলুন তো, ওই বাচ্চাটা কী দোষ করেছিল! কীসের আইন, কীসের প্রতিবাদ সেসব কি ও বুঝত? ওকে পাথর হাতে বিক্ষোভে শামিল করে দেয়া হয়েছিল।’ সাগিরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন জেলাপ্রশাসক কৌশল রাজ।
মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শনিবার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তরপ্রদেশের রামপুর। পুলিশ জানিয়েছে, বন্ধের মোকাবিলায় এদিন রামপুরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তা অমান্য করেই প্রায় ৫০০ লোক জড়ো হয়। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই বয়স ১২ থেকে ১৮-এর মধ্যে। হঠাৎই ওই জমায়েত থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোঁড়া শুরু হয়। আহত হন অন্তত ১৫ জন পুলিশকর্মী। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এই সংঘর্ষ চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী যায় ঘটনাস্থলে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়। তাতে অন্তত পাঁচজন প্রতিবাদকারী গুরুতর জখম হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলাপ্রশাসক আঞ্জনেয় সিং। অসমর্থিত সূত্রের খবর, তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে রাতে। পৃথক একটি ঘটনায় কানপুরের ইয়েতিমখানা পুলিশ চৌকিতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
তবে শুধু রামপুর নয়, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে গোটা রাজ্যেই যে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, তা পরিষ্কার ডিজির কথাতেই। তিনি বলেছেন, ‘রাজ্যের ৭৫টি জেলার এক-চতুর্থাংশেই শুক্রবার নামাজের পর আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি হয়। আমরা ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, সবকিছু শান্তিপূর্ণ থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। কিছু জায়গায় বিক্ষোভকারীদের হাতে অস্ত্রও ছিল। অন্তত ৫০ জন পুলিশকর্মী জখম হয়েছেন। মোট ২১টি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ রাজ্যের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শনিবার সকালে রাজ্যপাল আনন্দীবেন প্যাটেলের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বৈঠকের রাজ্যপাল বলেন, ‘দয়া করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। এই ধরনের হিংসাত্মক বিক্ষোভে শুধু সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হয়, মানুষের ক্ষতি হয়। কিন্তু কোনো সমাধান বের হয় না।’
উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশি দিল্লিতেও শনিবার উত্তেজনা ছড়ায় ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদের গ্রেফতারি নিয়ে। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও এদিন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখানো হয়। উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারীরা প্রতিবাদে শামিল হওয়ায় শনিবার বিক্ষোভের বহর ছিল অনেকটাই বড়। এদিন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ডাকা বন্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে গোটা বিহার। চেন্নাইয়ে সিপিএমের একাধিক সংগঠন ট্রেন অবরোধ করার চেষ্টা করলেও, পুলিশি তৎপরতায় তা ভেস্তে যায়। এককথায় সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ভারতজুড়ে হিংসাত্মক বিক্ষোভ অব্যাহত।
সূত্র : বর্তমান