ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর ও তার সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলায় আহত ধানমন্ডির চার্টার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র তুহিন ফারাবীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। হামলায় নুর ও তার সংগঠনের ৩১ নেতাকর্মী আহত হন। এরমধ্যে ভিপি নুরসহ চারজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
তুহিন ফারাবিকে রাখা হয়েছে আইসিইউর লাইফ সাপোর্টে। ক্যাজুয়ালটি ব্লকের আবাসিক সার্জন মো: আলাউদ্দিন সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, ফারাবির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন গ্রুপের নেতাকর্মীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন রড, লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে মধুর ক্যান্টিন এলাকায় অবস্থান নেয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভিপি নুরসহ তার সংগঠন সাধারণ ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীরা ডাকসু কার্যালয়ে অবস্থান নেয়। এর কিছুক্ষণ পর পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ডাকসু থেকে বের হলে তার উপর আতর্কিত হামলা চালায় নেতাকর্মীরা। এ সময় মামুন ডাকসুতে গিয়ে অবস্থান নেন। তখন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ডাকসু কার্যালয়ে অবস্থানরত নুরসহ প্রায় ২০জনের দিকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
নেতাকর্মীরা প্রায় ২০ মিনিটের তাণ্ডবে ডাকসুর জানালার গ্লাস, দরজা ভাঙচুর করে। পরে বাইরে থেকে ছোড়া ইট-পাটকেল দিয়ে ছাত্রলীগের ছোড়া পাটকেলের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন নুরের সঙ্গীরা। বেলা ১টার দিকে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ডাকসুতে প্রবেশ করেন। তারা সেখানে গিয়ে ভিপি নুরসহ তাদের নেতাকর্মীদের ডাকসু কার্যালয় ত্যাগ করতে চাপ দেন। কিন্তু নুরসহ অন্যরা তাদেরকে উপেক্ষা করে ডাকসুতেই অবস্থান করে। এ সময় সনজিত ও সাদ্দাম ছাত্র পরিষদের ১২ জনের মতো নেতাকর্মীকে এক এক করে বের করে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ডাকসু থেকে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা এক এক করে বের হচ্ছিল তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রড, লাঠি দিয়ে মারধর করে। এভাবে তারা প্রায় ১৫ জনকে মারধর করে আহত করে। তাদেরকে অন্যরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এ দিকে তাদেরকে বের করে দেয়ায় ছাত্রলীগ ও নুরুদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। তখন নুর সনজিতকে লক্ষ্য করে বলে ‘আপনি ডাকসুর কেউ না এখান থেকে যান’। জবাবে সনজিত চন্দ্র দাস তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। পরে সনজিত ও সাদ্দামসহ ডাকসুর সদস্য রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য বাইরে চলে আসে।
সরেজমিন দেখা যায়, সনজিত ও সাদ্দাম যখন ডাকসুর নিচ তলায় তখন ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা ডাকসু কার্যালয়ে প্রবেশ করে। এ সময় সনজিত তাদের উদ্দেশে বলে- ‘তাদের এমন মার দেবে যাতে তারা না মরে।’ এর পরক্ষণেই নেতাকর্মীরা ডাকসু কার্যালয়ে প্রবেশ করে লাইট অফ করে দিয়ে নুরসহ তাদের নেতাকর্মীদের ওপর রড, লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়।
হামলায় অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ একাংশের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, ঢাবি শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্য, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সাজু, এ এফ রহমান হল সংসদের জিএস রাহিম খান, এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী রাকিব, উচ্ছবল (চারুকলা), বিজয় একাত্তরের হলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ইউনুস, রবিউল হাসান রানা, সূর্যসেন হলের ভিপি মারিয়াম জামান খান সোহান, জিএস সিয়াম রহমান, ছাত্রলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু হল সংসদের জিএস শান্তসহ প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী। হামলায় অংশ নেয়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সনজিত এবং সাদ্দামের অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগের পদধারী এবং ছাত্রলীগের বি-টিম হিসেবে খ্যাত।
অভিযোগ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে সামনে রেখে ক্যাম্পাসের ঘটে যাওয়া ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। এর আগেও ক্যাম্পাসে অনেক হামলার ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
এ দিকে হামলায় নুরের মাথা ফেটে গেলে জ্ঞান হারান তিনি। তার সাথে থাকা মোহাম্মদ রাশেদ খানও সংজ্ঞা হারান। এ সময় হাসান আল মামুনের পা ভেঙে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক ফারুক হাসান ও মশিউর রহমানের মাথা ফেটে যায়, এ পি এম সুহেল ও ফারাবিকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইমরান হোসেন, নাজমুল হাসান, জাহিদ হোসেন, বিপ্লব, সুমন, আমিনুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, আরিফুল ইসলাম, সানা উল্লাহ, রফিকুল ইসলামসহ আরো অনেকে আহত হয়েছেন।
আহতদের বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, আহত ১৫ থেকে ২০ জন ভর্তি আছেন। ভোঁতা কিছু দিয়ে তাদের আঘাত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে।
এ দিকে তুহিন ফারাবিকে রাখা হয়েছে আইসিইউর লাইফ সাপোর্টে। ক্যাজুয়ালটি ব্লকের আবাসিক সার্জন মো: আলাউদ্দিন সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, ফারাবির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।
ভারতীয় হাইকমিশনের সেমিনার বাতিলের পরের দিনই হামলা : শনিবার ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একটি মিলনায়তনে ভারতে স্কলারশিপ নিয়ে দেশটির হাইকমিশনের সেমিনার ছিল। দেশটির সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরোধিতার মুখে তা আয়োজন থেকে ফিরে আসে হাইকমিশন। এর ঠিক পরের দিনই ডাকসু ভিপির ওপর হামলা চালান ইস্কনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযুক্ত সনজিত চন্দ্র দাসের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা। এ নিয়ে ভারতবিরোধিতার কারণে হামলা হয়েছে বলেও মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। এর আগে ভারতের এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ডাকসু ভিপি ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ব্যানারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
হামলার অন্তত ৪৫ মিনিট পরে পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী। এ সময় প্রক্টর ভিপি নুরুল হক নুরসহ অন্যদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন ডাকসু কার্যালয়ের ভেতরে সাংবাদিকদের প্রবেশ করেত বাধা দেন প্রক্টর। প্রক্টর ঘটনাস্থলে আসার প্রায় আধা ঘণ্টা পর ভিপি নুর, হাসান আল মামুন, রাশেদ, ফারুখসহ মোট ছয়জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।