অ্যাজমা বা হাঁপানি শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জিজনিত দীর্ঘমেয়াদি রোগ। বিভিন্ন অ্যালার্জেন, শ্বাসতন্ত্রের সংবেদনশীলতা এবং ফুসফুসের প্রদাহের জন্য শ্বাসনালিতে বাতাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, ফলে স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা শ্বাসকষ্ট হয়। একই সঙ্গে নিশ্বাসে সাঁই সাঁই শব্দ শোনা যায়। অ্যাজমা আক্রমণের সময় শ্বাসনালির আস্তরণ ফুলে যায়, ফলে শ্বাসনালি সংকীর্ণ বা চিকন হয়ে যায়। এর ফলে প্রশ্বাস ও নিশ্বাসে বাতাস চলাচলের গতি কমে যায় ও কষ্টসাধ্য হয়। লিখেছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন
অ্যাজমা রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও প্রধানত ২টি কারণ চিহ্নিত করা হয়-
১. বংশগত ‘এটোপি’-পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদানে অ্যালার্জি।
২. শ্বাসনালির অতি-সংবেদনশীলতা।
শিশুসহ যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি রোগ হওয়াতে সুচিকিৎসার অভাবে রোগী বেশ কষ্ট পায়। অ্যাজমা পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়, কিন্তু যত্নবান হলে এ রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
লক্ষণ : এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়-
কাশি, শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দেওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হওয়া, হাঁচি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, বুকে ভার অনুভব করা বা বুকের চাপা ব্যথা, জ্বর।
চিকিৎসা (ওষুধের মাধ্যমে)
ওষুধের মাধ্যমে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই ওষুধ খেয়ে রোগের প্রকোপ কমিয়ে রাখতে হয়। অ্যাজমার ওষুধ দুই ধরনের উপশমকারী ও প্রতিরোধককারী।
* শ্বাসনালির সংকোচন বন্ধ করতে উপশমকারী ওষুধ ব্রংকোডাইলেটর যেমন, সালবিউটামল, টারবিউটালিন, থিউফাইলিন, ব্যামবুটারল ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহৃত হয়। উপশমকারী ওষুধ তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসনালির ছিদ্রপথকে প্রসারিত করে শ্বাস-প্রশ্বাসের বাঁধা কমিয়ে দেয়। তবে এর কার্যকাল খুবই কম।
* প্রতিরোধককারী বা প্রদাহ নিরাময়ের ওষুধ, যেমন- কার্টিকোস্টেরয়েড (বেকলোমেথাসন, ট্রাইএমসিনোলোন, ফ্লোটিকাসন ওষুধ হচ্ছে স্টেরয়েড, ক্রোমোগ্লাইকেট ইত্যাদি, যা ধীরে ধীরে কাজ করে এবং লিউকোট্রাইন নিয়ন্ত্রক মন্টিলুকাস্ট, জেফিরলুকাস্ট ব্যবহার করা।
* প্রাথমিক পর্যায়ে উপশমকারী ব্রংকোডাইলেটর জাতীয় ওষুধের মাধ্যমেও কিছু নিয়ম মেনে অ্যাজমা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি
অ্যাজমার এসব ওষুধ নানাভাবে প্রয়োগ করা যায়। যেমন-
* ইনহেলার পদ্ধতি : এটি সবচেয়ে উপকারী এবং আধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ওষুধ নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে শ্বাসনালিতে কাজ করে। এগুলো ইনহেলার, রোটাহেলার, একুহেলার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
* ট্যাবলেট অথবা সিরাপ : ওষুধ রোগীর রক্তে প্রবেশ করে ফুসফুসে গিয়ে কাজ করে।
* নেবুলাইজার : তীব্র অ্যাজমার আক্রমণে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
* ইনজেকশন : অ্যাজমার মারাত্মক আক্রমণে স্টেরয়েড ইনজেকশন শিরায় দেওয়া হয়।
প্রতিরোধ (ওষুধবিহীন চিকিৎসা)
* অ্যাজমার অন্যতম প্রধান কারণ অ্যালার্জি। কোনো জিনিসে বা খাদ্যে কারও অ্যালার্জি থাকলে, তা যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত।
* কিছু কিছু বিষয়ে সচেতন হয়ে হাঁপানি থেকে পরিত্রাণ সম্ভব। অ্যালার্জেন নয়, অথচ শ্বাসকষ্ট বাড়ায় এমন জিনিস পরিহার। যেমন- মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা কমানো।
* অ্যালাজেন পরিহার : অ্যালার্জি দ্রব্যাদি এড়িয়ে চলা অ্যাজমার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা অর্থাৎ যে জিনিসে অ্যালার্জি তা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা।
* ধুলাবালি, ধোঁয়া, গন্ধ, ঘরের ঝুল ইত্যাদি এড়িয়ে চলা। ঘরের ভেতর কয়েল, ধূপ, সব রকমের ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীর শোবার ঘরটি সব সময় শুষ্ক, ধুলা ও মাইটমুক্ত হতে হবে।
ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকে সে ব্যবস্থা করুন। রাতে ঘুমানোর সময় পর্যাপ্ত উষ্ণতায় থাকুন।
* ঘর-বাড়িকে ধুলোবালি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা। এজন্য দৈনিক অন্তত একবার ঘরের মেঝে, আসবাবপত্র, ভেজা কাপড় দিয়ে মুছতে হবে অথবা ভ্যাকিউম ক্লিনার ব্যবহার করতে হবে।
* ঘরে কার্পেট না রাখা।
* বালিশ, তোষক, ম্যাট্রেসে তুলা ব্যবহার না করে স্পঞ্জ ব্যবহার করা।
* আতর, সেন্ট, পারফিউম ব্যবহার না করাই উত্তম।
* যেসব খাবার অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা পরিহার করা বা এড়িয়ে চলা।
* ধূমপান না করা।
* ফুলের রেণু পরিহার করতে হবে, সকাল কিংবা সন্ধ্যায় বাগান এলাকায় কিংবা শস্য ক্ষেতের কাছে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।
* কুকুর, বিড়াল, কবুতর ও পশু-পাখির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন।
অ্যালার্জি হয় এমন পরিবেশ পরিহার করা
* দিনে বা রাতে কুয়াশায় চলাফেরার সময় নাক ঢেকে রাখুন (গায়ে পর্যাপ্ত শীতের কাপড় থাকলেও)।
* স্যাঁতসেঁতে বা ঘিঞ্জি পরিবেশ এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা পরিবেশ ক্ষতিকর।
* রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় সম্ভব হলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন।
হাঁপানির (অ্যাজমা) আকস্মিক টান বা শ্বাসকষ্ট
হাঁপানি রোগীদের আকস্মিক শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে ধুলাবালি ও ধোঁয়া, ঘর ঝাড়মোছ করলে বা ফুলের রেণুর সংস্পর্শে এলে, কুয়াশা ও বদ্ধ গুমোট পরিবেশ, হঠাৎ ঠান্ডা আবহাওয়া, ঠান্ডা-শুষ্ক বাতাস রোগীর হাঁপানির টান বা শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে। শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাস সংক্রমণ, সর্দিকাশি হলেও এ ধরনের সমস্যা হয়। এসবই শ্বাসতন্ত্রের সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয় এবং শ্বাসনালিগুলোকে সংকুচিত করে, ফলে হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।
মনে রাখবেন, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে শুরুতেই কথা বলতে কষ্ট হলে বা জিব, নখ বা আঙুল নীল হয়ে এলে অথবা চেতনা হারিয়ে যেতে থাকলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে নেবুলাইজারের পাশাপাশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।
জটিলতা : অ্যাজমা কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে কি-না তা কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যায়। এ সময় উপশমকারী ওষুধের পরিমাণ বেশি লাগে এবং ইনহেলার দ্বারা ৩-৪ ঘণ্টার বেশি শ্বাসকষ্টের উপশম থাকে না। তাছাড়া রাতে শ্বাসকষ্টে ঘুম ভেঙে যাওয়া, স্বাভাবিক কাজকর্মে শ্বাসকষ্ট হওয়া, পিক ফ্লো ধীরে ধীরে কমাও জটিলতার লক্ষণ। তখন বিশেষ সতর্ক হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
শ্বাসকষ্টে তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় কী করবেন
* ছোট শিশুকে মাথা উঁচু করে শোয়াতে হবে এবং বড়দের সোজা হয়ে বসিয়ে জামা-কাপড় ঢিলা করে দিতে হবে।
* উপশমকারী সালবিউটামল বা ইপরাট্রোপিয়াম ইনহেলার স্পেসারের সাহায্যে ধীরে ধীরে চাপ দিতে হবে।
* স্পেসারের মধ্যে প্রতিবার এক চাপ দিয়ে তা থেকে পাঁচবার শ্বাস নিতে হবে। এভাবে পাঁচবার চাপ দিন।
* পাঁচ মিনিট বিশ্রাম দিন। তারপরও শ্বাসকষ্ট না কমলে আবার পাঁচ চাপ নিন। এভাবে মোট পাঁচবার (মোট ২৫ চাপ) নেওয়া যেতে পারে।
* এরপরও শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির টান না কমলে বাসায় নেবুলাইজার যন্ত্র থাকলে ব্যবহার করতে হবে বা রোগীকে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালে পৌঁছার আগ পর্যন্ত পাঁচ চাপ করে ইনহেলার নেওয়া চালিয়ে যেতে হবে।
সাবধানতা : শীতল আবহাওয়া, সর্দি-কাশি-ফ্লু বা ঠান্ডাজ্বরে হাঁপানির টান বা শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বেড়ে যায়।
* ইনহেলার সর্বদা হাতের কাছে রাখুন।
* নাক বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা অনেক সময় মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। মুখ দিয়ে নেওয়া শ্বাস শুষ্ক এবং শ্বাসতন্ত্র আরও সংকুচিত করে তোলে। অন্যদিকে নাক দিয়ে নেওয়া শ্বাস উষ্ণ এবং আর্দ্র, ধোঁয়া-ধুলা ইত্যাদি ফিল্টার হয়ে আসে। তাই শিশুদের বন্ধ নাক সব সময় স্যালাইন ড্রপ দিয়ে পরিষ্কার করে দিন।