বিদায়ী ২০১৯ সালে টানা তিন মাসজুড়ে সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পেঁয়াজ। মসলাদার এ পণ্যের ঝাঁজ টানা তিন মাস কাঁদিয়েছে ধনী-গরিব নির্বিশেষে ১৬ কোটি মানুষকে। মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত চলার পথে, হাটে-মাঠে-ঘাটে পেঁয়াজ ছিল মানুষের মুখে মুখে। পুরো সময়জুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সদস্যদের মুখরোচক স্ট্যাটাসের খোরাক জুগিয়েছে পেঁয়াজ। কার্গো বিমানযোগে পেঁয়াজ আমদানির ঘটনাও দেশে এবার প্রথম ঘটেছে। পেঁয়াজ নিয়ে রচিত হয়েছে নানা কৌতুক, ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন, হাস্য রসাত্মক রচনা। ৩০ টাকার পেঁয়াজ ছুঁয়েছে পৌনে তিন শ’ টাকার মাইলফলক। বছরের শেষ দিকে এসে দাম কমে এলেও ‘সাধারণ’ মসলা থেকে ‘দামি’ মসলার খাতায় পেঁয়াজের নামটি লেখা হয়েছে এবারই। সংশ্লিষ্টদের অনুমান, এখন থেকে বছরের সব সময়ই পেঁয়াজ কিনতে হবে অন্যান্য বছরের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ দামে।
সিবিএস সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর ২৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর দুই-তৃতীয়াংশ বা ১৬ লাখ মেট্রিক টনের চাহিদা দেশি পেঁয়াজে পূরণ হয়। বাকি আট লাখের প্রায় পুরোটাই আসে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত থেকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় পেঁয়াজ নিয়ে প্রতি বছরই কমবেশি সমস্যায় পড়তে হয়। দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে প্রায় প্রতি বছরই সঙ্কট দেখা দেয় এবং দাম বেড়ে যায়। তবে এবারই প্রথম পেঁয়াজ সঙ্কট টানা তিন মাস স্থায়ী হয়েছে। অন্যান্য বছরে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সঙ্কট কেটে যায়। দেশের ইতিহাসে এর আগে পেঁয়াজের দাম সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হতে দেখা যায়। তবে এবার ভারতেও পেঁয়াজ সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে বলে জানা গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগস্ট মাস পর্যন্ত খুচরা বাজারে দেশী পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়। এরই মধ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার সে দেশ থেকে পেঁয়াজ রফতানির ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ দর তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়। এ দিন পেঁয়াজের সর্বনি¤œ রফতানিমূল্য ৮৫২ ডলার নির্ধারণ করে দেয় ভারতের কাঁচা পণ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ন্যাপিড। তার আগে এ পণ্যটি টনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ মার্কিন ডলার মূল্যে আমদানি হতো। দেশটির বাজারে দাম বাড়ায় বাংলাদেশে পেঁয়াজের রফতানি নিরুৎসাহিত করতে ভারত এ কাজ করেছে বলে জানান এ খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে দেশে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। তার পর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত স্থায়ীভাবে পেঁয়াজ রফতানি নিষিদ্ধ করলে আগুন জ্বলে ওঠে দেশের বাজারে। ৪০ টাকা থেকে ৫০, ৬০, ৮০, ১০০, ১৫০, ২০০, ২২০, ২৫০ হয়ে ২৭৫ টাকা পর্যন্ত ওঠে এক কেজি পেঁয়াজের দাম।
এ সময়ের মধ্যে কার্গো বিমানে করে মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে থাকে সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন পেঁয়াজের ব্যাপারে। এ কাজে ব্যবহার করা হয় এস আলম, মেঘনা, সিটি গ্রুপের মতো অভিজ্ঞ কোম্পানিকে। পাকিস্তান, মিসর, চীন, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানিও হয় প্রচুর পরিমাণে। সরকার খোলাবাজারে ৪৫ টাকা কেজিদরে পেঁয়াজ বিক্রি করে। ট্রাকের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরেন নি¤œ এবং নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। পেঁয়াজ খাওয়ায় দেশবাসীকে নিরুৎসায়িত করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের রন্ধনশালায় পেঁয়াজ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন। পেঁয়াজ সঙ্কট মোকাবেলায় খাদ্য, বাণিজ্য, কৃষিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীরা রাত-দিন পরিশ্রম করেন। মোবাইল কোর্ট নামিয়ে একের পর এক অভিযান ও জেল-জরিমানা করা হয় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে পেঁয়াজের ঝাঁজ দেশে রাজত্ব করেছে টানা তিন মাস।
পেঁয়াজের বাজারে টানা তিন মাসের অস্থিরতায় হতাশা ব্যাক্ত করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে উপযুক্ত পরিসংখ্যান না থাকা এবং ঘাটতি পূরণে ভারতের কোনো বিকল্প না রাখায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে এ জাতীয় সঙ্কট এড়ানো সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার তো কত কিছুতেই ভর্তুকি দেয়। পেঁয়াজ চাষিদের ভর্তুকি বাড়িয়ে দিয়ে এবং তাদের মাঝে ন্যায্যমূল্যে বীজ-সার সরবরাহ করা গেলে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পেঁয়াজ নিয়ে আরেক সঙ্কটের বিষয় উঠে এসেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের গবেষণা প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা গেছে, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ফারাক মাত্র দুই লাখ টনের। বছরে দেশে পেঁয়াজ হয় ২৩ লাখ টনের ওপরে। আর চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টনের। তার পরও শুধু নষ্ট হওয়ার কারণে বছরে আট থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ দেশে উৎপাদিত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য যে আধুনিক তাপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকা দরকার, তা সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে নেই। যেখানে ভারত, চীন, মিসরের পেঁয়াজ দুই থেকে তিন মাসের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না। সেখানে বাংলাদেশের পেঁয়াজ পাঁচ থেকে সাত মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মার্চে বাংলাদেশের মাঠ থেকে পেঁয়াজ ওঠা শুরু হওয়ার পর তা নভেম্বর পর্যন্ত বাজারে বিক্রি হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূলত বিদেশী আমদানি পেঁয়াজের ওপরে নির্ভর করে দেশের বাজারের চাহিদা মেটানো হয়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা ওই পেঁয়াজ দ্রুত বাজারে বিক্রি করে দেন। বড় কৃষকরা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলেও তা বেশি দিন রাখা যায় না। দেশে চাল ও গম সংরক্ষণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর গুদাম রয়েছে। আলু রাখার জন্য রয়েছে হিমাগার। কিন্তু পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য এখন পর্যন্ত দেশে কোনো হিমাগার বা সংরক্ষণাগার গড়ে ওঠেনি। ফলে সংরক্ষণের সময় অতিবৃষ্টি হলে পেঁয়াজে ছত্রাক লেগে এবং শিকড় গজিয়ে তা দ্রুত তা নষ্ট হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর হিসাবে, বিশ্বের প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ হয় যুক্তরাষ্ট্রে, প্রায় ৫৭ হাজার টন। চীনে তা ২২ হাজার টন, ভারতে ১৬ হাজার টন এবং মিসরে ৩৬ হাজার টনের ওপরে। আর বিশ্বে গড়ে হেক্টরপ্রতি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় ২০ হাজার টন। কিন্তু বাংলাদেশের পেঁয়াজের গড় উৎপাদন এখনো ৯ হাজার ৭৭৭ টনে রয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদন প্রতি বছর ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বাড়ায় মোট উৎপাদন খরচ কমছে ৮ শতাংশ হারে। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের অর্ধেক আসে স্থানীয় জাতের পেঁয়াজ থেকে। তাহেরপুরী, ঝিটকা ও ফরিদপুরী নামের ওই সব পেঁয়াজের আকৃতি অবশ্য বেশ ছোট। এর হেক্টরপ্রতি উৎপাদন সাত হাজার থেকে আট হাজার কেজি। আর বারির বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ছয় জাতের পেঁয়াজ। এগুলোর উৎপাদন প্রতি হেক্টরে উৎপাদন ১০ থেকে ১১ হাজার কেজি। বেসরকারি বীজ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান লাল তীর থেকে লাল তীর কিং, লাল তীর হাইব্রিড এবং লাল তীর ২০ জাতের পেঁয়াজের বীজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এগুলোর উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১২ থেকে ১৩ হাজার কেজি।