হয় বোমার বিস্ফোরণ। নয়তো সতর্কতামূলক সাইরেন। মানুষের কানে কানে প্রকট শব্দ কিংবা আতঙ্কের আওয়াজ। ইউক্রেনের সামরিক প্রতিরোধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজধানী কিয়েভে ঢুকে পড়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কিয়েভের পতন অথবা পাল্টা সফল প্রতিরোধ- কোনোটাই নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে ক্রেমলিন থেকে যা হুঙ্কার শোনা গেছে, তাতে এটা বলা যায়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারের উৎখাত অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও ‘অনিবার্য’ বটে। যা কিছু ঘটে, পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকে। বলছেন স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্টও। ইউক্রেনে যা কিছু ঘটছে, এর জন্য আমেরিকাকেই দায়ী করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘এরপর আমরা দুইয়ে মিলে একটা সমঝোতায় পৌঁছাব।’
পূর্ব ইউরোপে সামরিক বিস্তারের অংশ হিসেবে ইউক্রেনকেও সদস্যপদ দেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাটোর মনে ও মুখে ছিল। ইউক্রেনও চেয়েছিল রাশিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য ন্যাটোর ক্লাবে ঢুকে পড়তে। ওদিকে, পুতিন দেখতে পাচ্ছিলেন, আশপাশের অন্য সব দেশের মতো ইউক্রেনেও ন্যাটো ঢুকে পড়লে রাশিয়া হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পরিণতির মুখে পড়তে পারে। ‘নিরাপত্তাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়’- এই নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু। পশ্চিমাদের গোয়েন্দা অনুমানকে সত্য প্রতীয়মান করে বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেনও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, যদিও সাফল্য পেয়েছে যৎসামান্যই।
দুই দিনের যুদ্ধে এরই মধ্যে ইউক্রেনের বেসামরিক মানুষসহ অন্তত ১৩৭ জন নিহত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার সাড়ে চারশ সেনা নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে বড় মোড় হলো, রাজধানী কিয়েভে রুশবাহিনীর ঢুকে পড়া।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, দ্বিতীয় দিনে রুশ বাহিনীর গতি কমে এসেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন সরকার কিয়েভের জনগণকে ককটেল বানাতে এবং শহরকে রক্ষা করতে যুদ্ধে নামার আহ্বান জানিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এও জানিয়েছে, স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করতে রাজি এমন লোকদের ১৮ হাজার মেশিনগান দেওয়া হয়েছে।
এদিকে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, রাশিয়া তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। মস্কোর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সাধারণ নাগরিক মারা গেছে এমন তিনটি ঘটনার হিসাব রাখছে সংস্থাটি। তারা বলছে, এটা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের ঘটনা।
গতকাল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ফোনে পুতিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু না পেয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ফোন করেন। দিনের প্রথম ভাগে ইমানুয়েল ম্যাক্রন পুতিনকে ফোন করে বার্তা পৌঁছে দেন যে, জেলেনস্কি তার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। কিন্তু ক্রেমলিন থেকে জানানো হয়, অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত কোনো আলোচনা হবে না। এর থেকেই বোঝা গিয়েছিল, মস্কোর মনে আর কিয়েভের কপালে কী আছে।
দিনের শেষ ভাগে পুতিন যখন মস্কোয় তার নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন, তখন এটি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জেলেনস্কি সরকারের পতনই পুতিনের প্রথম লক্ষ্য। এই সরকারকে তিনি ‘নব্য-নাৎসি’ বলে অভিহিত করে থাকেন। গতকালও তা-ই করেছেন। অবশ্য জেলেনস্কি- যিনি নিজে ইহুদি- এ অভিধাটি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ সম্পর্কে পুতিন বলেন, এই নব্য-নাৎসিবাহিনী কিয়েভ ও খারকিভে রকেট প্রস্তুত রেখেছে। পুতিনের ভাষায়, ‘বিশ্বে যেমন জঙ্গিদের দেখা যায়, এরাও তেমন কাজ করছে। তারা সাধারণ মানুষকে ঢাল করে যুদ্ধ করছে যেন, এ দাবি তুলতে পারে-রাশিয়া অনেক লোককে হত্যা করেছে।
চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, যা কিছু ঘটছে, সবই বিদেশি পরামর্শকদের প্রেসক্রিপশনে ঘটছে। সবার ওপরে আছে আমেরিকার পরামর্শদাতারা।’
এরপর পুতিন ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমি ইউক্রেনের সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের বলতে চাই, আপনাদের শিশু, স্ত্রী ও পরিবারের বৃদ্ধদের যুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য নব্য-নাৎসিদের কোনো সুযোগ দেবেন না; বরং ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিন। আপনারা আর আমরা মিলে যদি সমঝোতার পথ খুঁজি সেটাই বরং সহজ। কিয়েভের ওই মাদকাসক্ত বাহিনী ও নব্য-নাৎসিদের সঙ্গে কোনো কথা নেই।’
আলোচনায় পুতিনবিরোধী জোট প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি টুইটারে লিখেছেন, তার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথা হয়েছে। এ সময় তারা পুতিনবিরোধী ও যুদ্ধবিরোধী জোট এবং প্রতিরোধমূলক সহায়তা ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ জোরদারের বিষয়ে কথা বলেন। তিনি অপর এক টুইটে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে ‘সামরিক, কারিগরি ও মানবিক সহায়তা’ করার জন্য।
সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো গতকাল ব্রাসেলসে জরুরি বৈঠকে বসেছিল। এ সময় মস্কো থেকে আবার হুশিয়ারি দেওয়া হয়, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যদি ন্যাটোর সদস্য হয় তা হলে রাশিয়াও ‘খেল দেখিয়ে ছাড়বে’।
ওই বৈঠকে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনে যা কিছু হচ্ছে, এর জন্য রাশিয়া ও বেলারুশকে জবাব দিতেই হবে। তার ভাষায়, ‘রাশিয়া হলো দস্যু, বেলারুশ তার দোসর।’ ন্যাটো জানিয়েছে, পূর্ব ইউরোপে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে।
ওদিকে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্য প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। তবে এ অবরোধ হলো তাদের সম্পদ জব্দ করা, কোনো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।