বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শিশুদের মধ্যে আনন্দময় শিহরণ জাগায়। নতুন বইয়ের প্রতি শিশুদের এই আকর্ষণ সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে অদূরভবিষ্যতে একটি শুদ্ধ-শিক্ষিত জাতি আমরা আশা করতে পারি। দেশে প্রাথমিক শিক্ষা একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। তার আগে অনেক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণী ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার ফল বছরের শেষে নির্ধারিত সময়ে প্রকাশ করা গেছে। পাসের হার ও ভালো ফল সংখ্যার বিচারে আশাপ্রদ। আমাদের জাতীয় জীবনে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। সেই সময় দৃশ্যত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের সঙ্কটটি হলো দুর্নীতি, বিচারহীনতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। আজকের শিশুরা জাতির আগামী দিনের কর্ণধার; তারা যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয় তাহলে বর্তমান সঙ্কটের অপনোদন হবে না।
প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণী মিলে এবার ৪৩ লাখ শিশু উত্তীর্ণ হয়েছে। এটা এক বিরাট সফলতা। কারণ, পৃথিবীর অনেক দেশই রয়েছে, যেখানে ৪৩ লাখ মানুষও নেই। সেই অর্থে আমাদের দেশের কেবল দুটো শ্রেণীতে পাস করা এই শিশুদের যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়; তাহলে একটি জনকল্যাণমূলক দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলে চার কোটি ২৭ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জন্য সরকার প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি বই ছাপিয়ে বছরের শুরুতে সরবরাহ করেছে। একে একটা মহাকাণ্ড বলা যেতে পেরে। এমন একটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে অনেক প্রস্তুতি ও সতর্কতার প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে ছাপার বিভ্রাটও একটি বিরাট ব্যাপার। বই ছাপানোর ক্ষেত্রে এমন বিভ্রাট আগের চেয়ে কমেছে। আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে অনেক উন্নতি করেছি বলা যায়।
প্রত্যেকটি শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা বিরাট একটি কাজ। সেটি আমরা করতে পেরেছি। আমাদের একটা বিষয় লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, সঙ্কট ও সমস্যা চিহ্নিত করা। প্রথমেই বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। যারা জাতীয় ক্ষেত্রে বড় বড় অন্যায় করছেন তারা প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত। তারা আমাদের দেশেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করছেন। শিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় নৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি তা প্রতীয়মান নয়। আমরা কী পড়ছি সেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পরিশোধন হতে পারে এমন আধেয় আমাদের পাঠ্যে নেই। সেটি যদি থাকে তাহলে জাতীয় ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন ঘটত।
মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় আমাদের সফলতা পরিসংখ্যানগত। একে গুণগত সফলতায় রূপান্তর করতে হলে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বিজ্ঞান গণিত সাহিত্য শিক্ষার সাথে নৈতিক শিক্ষার শক্ত বাঁধন যদি না থাকে তাহলে সেটি কার্যত কোনো সফলতা বয়ে আনবে না। সেটি হবে অনেকটাই হালহীন নৌকার মতো। যে জাতি প্রকৃত মূল্যবোধ শিখতে পারেনি তাকে কোনোভাবে একটি শুদ্ধ সংস্কৃতবোধসম্পন্ন জাতি বলা যেতে পারে না। আমাদের জাতীয় জীবনে যে সঙ্কীর্ণতা চলছে, তাকে বদলে দিতে হলে শিশুদের শিক্ষার আধেয় সেভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যাতে একজন নাগরিক কোনোভাবে দুর্নীতি করার প্রেরণা পাবে না। বরং অনিয়ম-অন্যায়কে সে ঘৃণা করবে। তাই আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় প্রয়োজনের নিরিখে সেগুলোকে সংশোধন পরিমার্জন সংযোজন করতে হবে।