সরকারি-বেসরকারি ১৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর বাইরে আরও ৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি রয়েছে। সব মিলিয়ে ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ২২ ব্যাংকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি সপ্তাহে এ চিঠি পাঠানো হবে। চিঠিতে জানতে চাওয়া হবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার পদক্ষেপ ও কৌশল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণত ৫ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণকে সহনীয় বলা হয়। আর ১০ শতাংশের ওপরে হলে তা উদ্বেগজনক। তাই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত তদারকি করা হয়। এর অংশ হিসেবে ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকগুলোয় চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ করে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি, তাদের পক্ষে প্র্রয়োজনীয় প্রভিশন ও মূলধন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ওইসব ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও ঘোষণা করতে পারে না। অন্যদিকে, খেলাপি ঋণ বেশি থাকলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে কমে যায় আয়। এ ছাড়া ঋণের সুদহারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বিদায়ী বছরজুড়ে নানা ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুই-ই বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ সময়ে ২২টি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনক। এ তালিকায় আছে সরকারি খাতের ৯টি, বেসরকারি খাতের ৫টি ও বিদেশি খাতের ১ ব্যাংক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেসিক ব্যাংকের ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৯৮, সোনালী ব্যাংকের ১৭ দশমিক ৯৬, রূপালী ব্যাংকের ১৪ দশমিক ৯০ এবং অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৫ দশমিক ১৫, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ১২ দশমিক ৭৫ ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সমস্যাগ্রস্ত আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৭৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আরেক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এবি ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এর বাইরে এ খাতের আরও ৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে আছে। এগুলো হলো ওয়ান ব্যাংকের ৮ দশমিক ৬১, উত্তরা ব্যাংকের ৬ দশমিক ৯৬, স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ৬ দশমিক শূন্য ৯, আইএফআইসির ৫ দশমিক ৯৬, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৫ দশমিক ৪৭, সাউথ বাংলার ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ ও ব্যাংক এশিয়ার ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি খাতের দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার অত্যধিক বেশি। এগুলো হলো সমস্যাগ্রস্ত ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৯৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ ও হাবিব ব্যাংকের ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এগুলো হলো সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, আইসিবি ইসলামিক, বাংলাদেশ কমার্স ও ন্যাশনাল ব্যাংক। একই কারণে ৯টি প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। এগুলো হলো জনতা, বেসিক অগ্রণী, রূপালী ন্যাশনাল, বাংলাদেশ কমার্স আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক।