ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সামরিক কমান্ডারকে হত্যায় ড্রোন হামলা করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশ দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই হামলায় নিহত হন ইরানের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাশালী জেনারেল জেনারেল সুলেইমানি। এখানে কী কৌশল কাজ করেছে? এরপরেই বা কী ঘটতে পারে?
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার বিষয়টি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তার আমলে, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো বেশি উত্তেজনার হয়ে উঠেছে, যেহেতু তিনি ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছেন এবং ইরানের ওপর আরো অবরোধ আরোপ করেছেন।
এখানে যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন আন্তর্জাতিক নীতি বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী থাকতে পারে এবং তা যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের সম্পর্কের জন্য কী অর্থ বহন করে?
ট্রাম্প কোন বড় কৌশলবিদ নন
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রেডলাইন: আমেরিকান ফরেন পলিসি এন এ টাইম অফ ফ্রাকচারড পলিটিক্স এন্ড ফেইলিং স্টেট বইয়ের লেখক পিজে ক্রাউলি
কেন এখন হামলা?
ইরানের সমর্থনপুষ্ট মিলিশিয়াদের কাছ থেকে আমরা হামলার শিকার হয়েছি এবং তারই জবাব হিসাবে তাদের নিজের এলাকা ইরাক ও সিরিয়ায় হামলা করা হয়েছে। ইরাকের বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলার ঘটনাটি ট্রাম্প প্রশাসনকে চমকে গিয়েছিল, যা তারা উস্কানি হিসাবে দেখেছে এবং সোলেইমানি এর পেছনে রয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস। সুতরাং তাকে একটি টার্গেট হিসাবে পাওয়ায় প্রেসিডেন্ট হামলার অনুমোদন দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশল কী?
ডোনাল্ড ট্রাম্প কূটকৌশলে বিশেষভাবে দক্ষ ব্যক্তি নন। তিনি যেন মুহূর্তে বিশ্বাস করেন এবং তার অনুভূতি দ্বারা চালিত হন। আমি অবাক হবো যদি তিনি পুরো ঘটনার পরে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা করে থাকেন। তার সামনে সম্ভবত একজন ‘খারাপ ব্যক্তিকে’ সরিয়ে দেয়ার সুযোগ তুলে ধরা হয়েছে, যা বারাক ওবামা পাননি। তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সম্ভবত এটাই শোনার দরকার ছিল।
এরপরে তাহলে কী ঘটতে পারে?
ইরান এই হামলার জবাব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইরানের পক্ষে অনেকেই পুরো অঞ্চল জুড়ে হামলা করার মতো উৎস খুঁজবে। তারা আমেরিকার রাজনীতি ভালোভাবেই বোঝেন এবং মি. ট্রাম্পের পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার প্রধান চাবিকাঠি হলো মার্কিন অর্থনীতি। তাদের যদি সেটা বিনষ্ট করার কোন সুযোগ থাকে, তাহলে তারা তা করবে।
থিওরি অনুযায়ী, ‘ভালো একটা চুক্তি’ করার জন্য ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসাতে চাপ দিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে ইরান এলে তাদের যেমন পরমাণু কর্মসূচী ছাড়তে হবে, তেমনি মিসাইল কর্মসূচী এবং আঞ্চলিক প্রভাবও ছাড়তে হবে।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে যে, এই পদক্ষেপ আলোচনাকে তরান্বিত করে কিনা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, পুরো অঞ্চল জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রর জন্য খুব তাড়াতাড়ি প্রশংসা শুরু হবে।
জেরুজালেম এবং রিয়াদের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো সত্যি হতে পারে। কিন্তু এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলো পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা প্রত্যাহারে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতির কী হবে
ইরান নীতির ব্যাপারে প্রথম থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশলের যে বৈপরীত্য রয়েছে, তা সমাধানের চেষ্টা করেননি মি.ট্রাম্প। তিনি ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ দিয়ে যেতে চান, পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাও সরিয়ে আনতে চান।
যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ নিয়ে ক্রমাগত সমালোচনা করছেন, তিনি বলছেন, এখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার কিছু নেই, তখন তিনি এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের লড়াই রাজনৈতিক ও অর্থনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরাদস্তুর যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
লাঠি ও গাজর
উইলিয়াম টোবে হার্ভাড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো এবং ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাবেক উপ-প্রশাসক
কেন এখন হামলা?
এখন এই হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ দেয়ার চেষ্টা করছে। অর্থনৈতিক উত্তেজনা থেকে সামরিক উত্তেজনার পথ বেছে নিয়েছে তেহরান। প্রথমে তারা তেলের ট্যাংকার ও স্থাপনায় হামলা করেছে, পরবর্তীতে কনট্রাকটরদের ওপরে।
এটাকে এভাবেও দেখা যেতে পারে যে, উত্তেজনা প্রশমনে তেহরানকে বাধ্য করা, এই বার্তা দেয়া: ”দেখো, এসব কাজ তোমাদের কোন সুবিধা দেবে না।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশল আসলে কী?
তিনি আসলে একটা জটিল নীতি বেছে নিয়েছেন। ইরানের ওপর অনেক চাপ দেয়া যাতে, দেশটির সামনে আলোচনায় বসা এবং একটি চুক্তিতে রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা না থাকে। আবার এতো বেশি চাপ না দেয়া যাতে, ইরানের মনে হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে যেনতেন একটা চুক্তি তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
বিষয়টাকে এভাবে দেখা যোত পারে, সোলেইমানির ওপর হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের লাঠি দেখাচ্ছে। আবার সেই ইরানকে গাজরের লোভ দেখানো হচ্ছে এই বলে যে, ”দেখো, আমরা তো ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চাই না।”
এরপরে কী হতে পারে?
ইরানকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে দেখা গেছে আর দেশটি তাদের মুদ্রামানও কমিয়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় হেরে গিয়ে ইরান সিদ্ধান্ত নিয়েছে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার। এর আগেও দেখা গেছে যে তেহরান বেশ বড় ধরণের ঝুঁকি নিয়েছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে যে, তাদের সেই ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা আরো বাড়বে।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, কোনটির আগে অবসান হয়, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেয়ার ক্ষমতার নাকি তেহরানের সেটি মোকাবেলা করার ক্ষমতার?
মধ্যপ্রাচ্য থেকে সৈন্য সরাতে তার প্রতিশ্রুতির কী হবে?
জার্মানিতে মার্কিন সৈন্য পছন্দ করেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প। সুতরাং নির্বাচনী এই বছরে তিনি ইরানে সেনা পাঠানোর মতো কোন কাজ করবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি এটাও প্রদর্শন করতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বেশি পরিমাণে ধাক্কা হজম করতে হচ্ছে। সূত্র : বিবিসি।