পবিত্র মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের প্রথম দিনই মুসলমানদের জন্য এক আনন্দ-উৎসবের দিন। যা ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত। যার অর্থ রোজা খোলার আনন্দ। কিন্তু আল্লাহ-রাসূলের অনুমোদিত বিশ্ব মুসলিমের জন্য এ দিবসটি শুধুই আনন্দ-ফুর্তির দিন কিংবা নিছক ভোগবিলাসের জন্যই নির্ধারিত নয়। সাম্যের ধর্ম, ভ্রাতৃত্বের ধর্ম ইসলাম দাবি করে ভিন্ন কিছু। আর সেটিরই বাস্তব রূপ ঈদুল ফিতরে নিহিত। ঈদুল ফিতরের সে আনন্দ উপভোগ করার মাধ্যম হচ্ছে সাদকাতুল ফিতর।
ফিতর একটি আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ রোজা ভাঙা। হাদিসে একে জাকাতুল ফিতর বা সাদকাতুল ফিতরÑ এ দুই নামেই অভিহিত করা হয়েছে। হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার সাথে সাথে সাদকাতুল ফিতরকেও ওয়াজিব করা হয়েছে।
ইসলামে সাদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রধান কারণ দু’টি। পবিত্রকরণ ও পারস্পরিক অংশগ্রহণ। পবিত্রকরণ এ জন্য যে, এক মাসকালীন সিয়াম সাধনাকারীর যাবতীয় ছোটখাটো ভুলত্রুটি থেকে পবিত্র হওয়ার উপায় এই ফিতরা প্রদান। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে শাওয়ালের এক তারিখে ঈদ উৎসবের আনন্দে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা।
হাদিসে আছে রাসূল সা: বলেছেন, ‘আজ তাদেরকে ধনী করে দাও অর্থাৎ ঈদের দিন গরিব মিসকিন ও অসহায় মানুষকে ধনীদের মতো আনন্দ দান করার উদ্দেশ্যে সচ্ছল করে দাও। হাদিস থেকে আরো জানা যায়, নবী করিম সা: শহরের অলিতে-গলিতে লোক পাঠিয়ে এ ঘোষণা করে দেন যে, সাবধান! সদকায়ে ফিতর প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, আজাদ-গোলাম, ছোট-বড় সবার ওপর ওয়াজিব’ (তিরমিজি)।
কার ওপর ফিতরা ওয়াজিব : সাধারণত যার নিকট জাকাত ফরজ হওয়ার পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকে তার ওপর সাদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। এ ক্ষেত্রে পূর্ণ বছর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার দরকার নেই। বরং যার কাছে ঈদুল ফিতরের দিন সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত এক রাত একদিনের খাবার মজুদ আছে তার ওপরই ফিতরা ওয়াজিব। চাই সে স্বাধীন কি দাস, পুরুষ বা নারী, বালেগ কি নাবালেগ। ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের আগে যে শিশুটি জন্ম নেবে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব।
সাদকাতুল ফিতর কী দিয়ে দিতে হবে : হাদিসের আলোকে জানা যায়, এর জন্য উত্তম দান হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। যার ফলে মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবের ইমামদের মতে যেহেতু রাসূল সা:-এর যুগে খাদ্যদ্রব্য দিয়েই ফিতরা দেয়া হয়েছে সেহেতু টাকা পয়সা দিয়ে তা দেয়া জায়েজ হবে না কিন্তু হানাফি আলেমরা বলছেন অন্যরকম। তারা বলেন, টাকা পয়সা দিয়েও ফিতরা দেয়া জায়েজ।
সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ : আবদুুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূল সা: লোকদের ওপর সাদকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন, যার পরিমাণ এক সা’ খেজুর, এক সা’ জব (সহিহ মুসলিম)। আবু সাইদ খুদরি রা: বলেন, আমরা সাদকাতুল ফিতরা হিসেবে এক সা’ খাদ্যদ্রব্য যেমনÑ এক সা’ জব/এক সা’ খেজুর/এক সা’ পনির/এক সা’ কিশমিশ দিতাম (বুখারি ও মুসলিম)। সা’ হচ্ছে মদিনায় প্রচলিত খাদ্যশস্য পরিমাপের একক বা পাত্র। তৎকালীন মদিনায় প্রচলিত আকারের এক সা’ সমপরিমাণ বর্তমানকালের গম ২১৭৬ গ্রাম, চাল ২৫২০ গ্রাম , খেজুর ২৪৮০ গ্রাম। মূলত যখন যে সময়ে যে দেশের প্রধান খাদ্য যা হবে এবং যে ব্যক্তি যে ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন এমন কি তার মূল্য যেমন হবে তার ভিত্তিতেই সাদকাতুল ফিতর দিতে হবে। আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়ে ঘোষণা দেয়া হয় আমাদের সেটিই অনুসরণ করতে হবে।
ফিতরা কাদেরকে দিতে হবে : সাদকাতুল ফিতর হচ্ছে শুধু মুসলিম ফকির, মিসকিন, অভাবীদের হক। হাদিসে এসেছে, ‘সাদকাতুল ফিতর মিসকিনদের খাবার প্রদানের নিমিত্তে ফরজ করেছেন’ (আবু দাউদ-১৬১১)। এ হাদিস দ্বারা জানা যায়, অপেক্ষাকৃত বেশি গরিব বা মিসকিনকে দিতে হবে এ সাদকা। এক ব্যক্তির ফিতরা যেমন একজনকে দেয়া যায় তেমনি আবার একাধিক লোককেও দেয়া যায়। তদ্রƒপ অনেকের ফিতরাও শুধু যেমন একজনকে দেয়া যাবে তেমনি অনেকের মধ্যেও একজনেরটা ভাগ করে দেয়া যায়।
ফিতরা প্রদানের সময় : ফিতরা প্রদানের সময়কাল দু’টি। তা হলোÑ উত্তম সময় ও বৈধ সময়। উত্তম সময় হচ্ছে শেষ রোজার সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত এবং বৈধ সময় হচ্ছে ঈদের দু-এক দিন আগেই ফিতরা দেয়া। হজরত ইবনে ওমর রা: বলেছেন, নবী করিম সা: লোকদের ঈদের সালাত আদায় করার আগেই ফিতরা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারি মুসলিম)। অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তা ঈদের সালাতের আগে আদায় করবে, তার আদায়টি সাদকাতুল ফিতর হিসেবে গৃহীত হবে কিন্তু যদি সালাতের পরে আদায় হয় তবে তা নিছক দান হিসেবে ধর্তব্য হবে (আবু দাউদ)।
ফিতরা আদায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি : মূলত পরিবারের প্রধানই সবার পক্ষ থেকে এ দায়িত্বটি পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে যাদের পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে তারা সিয়ামপালনকারী হতে হবে এমন শর্ত নেই বরং তাদের অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। এ জন্যই যে শিশুটি সুবহে সাদিকের আগে জন্ম নেবে তারও ফিতরা আদায় করতে হবে।
সাদকাতুল ফিতরের উপরিউক্ত বিধানমালা থেকে বোঝা যাচ্ছে, সমাজে ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ মুছে দিয়ে সাম্যও প্রীতির একটি সেতুবন্ধন গড়ে তোলার জন্যই সাদকাতুল ফিতরের ব্যবস্থা এবং তা ঈদুল ফিতরের দিনই এমনকি সালাতের আগেই আদায় করা উত্তম।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট