ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে সৌন্দর্যের অপরূপ ভূমি চট্টগ্রামের মিরসরাই। ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের বরণ করতে প্রস্তুত এখানকার পর্যটন স্পটগুলো। এখানে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মহামায়া সেচ প্রকল্প, দেশের ৬ষ্ঠ সেচ ও প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প মুহুরী প্রজেক্ট, আটস্তর বিশিষ্ট জলপ্রপাত খৈয়াছড়া ঝর্ণা, রূপসী ঝর্ণা, বাওয়াছড়া প্রকল্প, বোয়ালিয়া ঝর্ণা, ডোমখালী বেড়িবাঁধ ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের বসুন্ধরা পয়েন্ট। প্রাণের তাগিদে ঈদের ছুটিতে প্রকৃতির অতি কাছাকাছি যেতেই হয়। তাই সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতির সাথে এবারের ঈদেও মুখর হবে মিরসরাইয়ের জনপদ। প্রাণের টানে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া প্রকৃতিপ্রেমীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে মহামায়া, খৈয়াছড়া, বাওয়াছড়া ও মুহুরীর অনাবিল সৌন্দর্য।
মহামায়ার প্রকৃতিতে রঙের ছড়াছড়ি : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার ঠাকুরদীঘি বাজারের এক কিলোমিটার আগে ছায়াঘেরা সড়ক। যে কোনো স্থান থেকে এসে লেকে যেতে রাস্তায় প্রস্তুত থাকে সিএনজি অটোরিকশা। কিছুদূর পর দেখা মিলবে রেলপথ। রেল লাইন পেরুলেই কাছে টানবে মহামায়া। প্রাণের টানে ছুটে আসা পথ যেন ক্রমেই বন্ধুর হতে চাইবে মনের কোণে জাগা মৃদু উত্তেজনায়। দূর থেকে দেখা যায় প্রায় পাহাড়সম বাঁধ। উভয় পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বাঁধের ধারে অপেক্ষমাণ সারি সারি ডিঙি নৌকা আর ইঞ্জিনচালিত বোট। ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের লেক কেবলই শোভা ছড়ায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে স্বচ্ছ পানিতে তাকাতেই দেখা যায় নীলাকাশ। পূর্ব-দিগন্তের সারি পাহাড়ের বুক চিরে যেতে যেতে একসময় হারিয়ে যেতেও মন চাইবে কল্পনায়। কিছু দূরেই দেখা যাবে পাহাড়ের কান্না। অঝোরে কাঁদছে। অথচ তার কান্না দেখে নিজের কাঁদতে ইচ্ছে হবে না। তাছাড়া কান্নার জলে গা ভাসাতে মন চাইবে। তারও আগে যেখানে লেকের শেষ প্রান্ত, সেখানেও বইছে ঝর্ণাধারা। কি নীল, কি সবুজ, সব রঙের ছড়াছড়ি যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে মহামায়ার প্রকৃতিতে।
রূপসী ঝর্ণার রূপে পাগল হবে যে কেউ : মনটা যতই খারাপ থাকুক রূপসী ঝর্ণায় পা রাখলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে নিশ্চিত। রূপসী ঝর্ণার রূপের জাদু আপনাকে পাগল করবে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বড় কমলদহ রূপসী ঝর্ণা। আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সবুজ শ্যামল মেঠোপথ পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গেলেই শোনা যাবে ঝর্ণার পানি গড়িয়ে পড়ার অপরূপ নুপুরধ্বনি। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়। সাঁ সাঁ শব্দে উঁচু পাহাড় থেকে অবিরাম শীতল পানি গড়িয়ে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে। রূপসী ঝর্ণা প্রথম দেখেই তার রূপে পাগল হবে যে কেউ। মেঘের মতো উড়ে আসা শুভ্র এ পানি আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেই এর শীতল পরশ মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দেবে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্যটকরা আবিষ্কার করবেন লাল আর নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল! যত দূর পর্যন্ত ঝিরিপথ গেছে তত দূর পর্যন্ত তাদের মনমাতানো ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন শোনা যায়। চলার পথে শোনা যায় হরিণের ডাক। বিভিন্ন স্থান হতে যে কোনো বাসযোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় দারোগাহাট বাজারে নামবেন। এরপর সিএনজি অটোরিকশা যোগে বাজারের উত্তর পাশের ব্রিকফিল্ড সড়ক দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাবে। এরপর পায়ে হেঁটে ঝর্নায় যাওয়া যাবে।
সৌন্দর্যের আরেক নাম খৈয়াছড়া ঝর্ণা ঃ নান্দনিক তুলিতে আঁকা খৈয়াছড়া ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। অনেকে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝরনার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু টাঙ্গিয়ে অবস্থান করছে। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়, যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে, ঝুমঝুম শব্দে বয়ে চলা ঝরনাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলছে খৈয়াছরা ঝরনায়। গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকা বাঁকা মেঠোপথ পেরিয়ে শরীরটা একটু হলেও ভিজিয়ে নেয়া যায় নিঃসন্দেহে। আট স্তরের ঝরনা দেখতে দেশি-বিদেশী পর্যটকের ভিড় পড়েছে। দেশের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক ঝরণাটি দেখতে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে হাজার হাজার দেশি-বিদেশী পর্যটক।
বাওয়াছড়ার দৃশ্য নজর কাড়ে ঃ উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর বাওয়াছড়া পাহাড়িয়া এলাকায় যুগ যুগ ধরে ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। সবুজ শ্যামল পাহাড়িয়া লেকে পাখিদের কলতানে আবালবৃদ্ধবণিতা সবার প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ স্থানে ছুটে আসে শত শত পর্যটক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় কমলদহ বাজার থেকে থেকে ২ কিলোমিটার পূর্বদিকে এটি অবস্থিত।
মুহুরীর চরে পানি আর রোদের খেলা : প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্য মুহুরী। যেখানে আছে আলো-আঁধারীর খেলা। আছে জীবন-জীবিকার নানা চিত্র। মুহুরীর চর, যেন মিরসরাইয়ের ভেতর আরেক মিরসরাই। অন্তহীন চরে ছোট ছোট প্রকল্প। এপারে মিরসরাই, ওপারে সোনাগাজী। ৪০ দরজার রেগুলেটরের শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায় দূর থেকে। পশ্চিমে মৎস্য আহরণের খেলা, আর আগে মন কাড়ানিয়া প্রকৃতি। নুয়ে পড়া মনোবল জেগে উঠবে পূবের জেগে ওঠা চরে। ডিঙি নৌকায় ভর করে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলবে সাদা সাদা বক। এখানে ভিড় করে সুদূরের বিদেশী পাখি, অতিথি পাখি বলেই অত্যধিক পরিচিত এরা। চিকচিকে বালিতে জল আর রোদের খেলা চলে সারাক্ষণ।
সামনে পেছনে, ডানে-বামে কেবল সৌন্দর্য আর সুন্দরের ছড়াছড়ি। এ অবস্থায় মন আঁধারে ঢেকে যেতে পারে, যদি ক্যামেরা সাথে না থাকে। মুহুরীর প্রকৃতির ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত স্মৃতিরা যেন হারিয়ে যাওয়ার নয়। এসব ক্যামেরার ফিল্মে আটকে রাখার মতো হাজার বছর ধরে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পুরাতন জোরারগঞ্জ বাজারে নেমে ধরতে হবে সংযোগ সড়কের পথ। জোরারগঞ্জ-মুহুরী প্রজেক্ট সড়ক নামে এ সড়কে দেখা মিলবে হরেক রকমের মোটরযানের। ভাঙাচোরা আঁকাবাঁকা আধাপাকা সড়ক পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৮ কিলোমিটার। এরপর মুহুরী প্রকল্পের বাঁধ। যেতে যেতে ২ কিলোমিটার পরই দেখা মিলবে আসল সৌন্দর্য।