আল্লাহ তায়ালা মানুষের মঙ্গলের জন্য অসংখ্য নিয়ামত দ্বারা মেহেরবানি করেছেন। এই নিয়ামতের সংখ্যা এত অধিক যে, তা গণনা করা বা পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভবপর নয়। দ্বীন ইসলাম থেকে শুরু করে আসমান-জমিন সর্বত্রই তাঁর নিয়ামতসমূহ পরিব্যপ্ত। মানুষের শোকর-গোজারি হওয়ার এক বিশাল ক্ষেত্র। আল্লাহ তায়ালা পরম পবিত্র। কোনো প্রকার অপবিত্রতা তাঁকে স্পর্শ করে না। তাঁর ইবাদতের জন্য মানুষকে তাই দেহ ও মনে পবিত্র হতে হবে। তিনি ইবাদতের জন্য মানুষ ও জিন সৃষ্টি করলেও যদি কেউ তাঁকে ইবাদত না করে তাহলে যেমন তিনি পরোয়া করেন না, তেমনি যদি সবাই তাঁর ইবাদত করে, তাহলেও তাঁর কিছুই বৃদ্ধি পায় না। (সূরা ফোরকান, আয়াত-৭৭) আল্লাহর ইবাদত মানুষের নিজের কল্যাণের জন্যই। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালার হাত-পা, চোখ-মুখ, কান ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলো মানুষের হাত-পা, কান দ্বারা বোঝা যাবে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা কোনো কিছুর মতো নন। (সূরা শূরা, আয়াত-১১) এবং তিনি দৃশ্যমানও নন বিধায় আল্লাহ তায়ালার চেহারাকে কল্পনা করা বা তাঁর জাতকে বোঝা মানুষের সাধ্যাতীত। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টির বিষয়ে গবেষণা করো, আল্লাহকে নিয়ে গবেষণা করো না।’ (তিরমিজি)
তাঁর জাতকে চেহারায় বা মূর্তিতে কল্পনা করা কঠিন গোনাহ। হজরত মুসা আ: আল্লাহ তায়ালাকে দেখার জন্য অভিলাষ জ্ঞাপন করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ধমক দিয়েছিলেন, তুমি কখনোই দেখতে পাবে না। (সূরা আ’রাফ, আয়াত-১৪৩) দুনিয়াতে তাঁকে কোনো অবস্থাতেই দেখা যাবে না। তাঁকে দেখা যাবে বেহেশতে এবং তারাই দেখবেন যারা ভালো আমল করেছেন ও আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করেননি। (সূরা কাহফ, আয়াত-১১০) সুতরাং দুনিয়াতে যারা আল্লাহকে দেখেন বলে বলেন, তাদের সে ভুয়া কথায় কর্ণপাত করা যাবে না।
গুণ প্রকাশক শব্দ দ্বারা আল্লাহর গুণ প্রকাশ করা যায় না। কারণ মানুষ তার নিজের জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই গুণ প্রকাশক শব্দ ব্যবহার করে। কিন্তু মানুষের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। (সূরা বনি-ইসরাইল, আয়াত-৮৫) তারা আল্লাহ তায়ালার গুণসমূহকে ধারণায় আনতে সমর্থ নয়। না মানুষ আল্লাহকে দেখেছে, না আল্লাহ কোনো কিছুর মতো, না আল্লাহর জাত ও সিফাতকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জ্ঞান ও ক্ষমতা মানুষের আছে।
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি পরিপূর্ণ রূপে তোমার গুণকীর্তন করতে পারি না। অতএব তুমি সেই রূপই যেমন তুমি স্বয়ং তোমার প্রশংসা করেছ।’ (মিশকাত)
মানুষের আত্মা বা রুহ আল্লাহর সৃষ্টি। স্র্রষ্টার সাথে সৃষ্টি কোনোভাবেই মিশে যেতে পারে না। এই আত্মা বা রুহ মানুষের দেহ ত্যাগ করে আল্লাহর সাথে মিশে যায় বলা চরম ভুল ও গোনাহ। আল্লাহ তায়ালা কারো দিল বা কলবের মধ্যে প্রবেশ বা অবস্থান করেন না। তবে দিল আল্লাহ সম্পর্কিত ইলমের কেন্দ্রভূমি এবং আল্লাহ-সৃষ্ট নূরের তাজাল্লি দ্বারা রওশনপ্রাপ্ত হয়। আর তখন ইলমে-লাদুন্নি হাসিল হয় এবং অদৃশ্য জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের অনুভূতি নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়। আল্লাহর কালাম বা কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট মনে করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালার সিফাতের মতো কদিম, জাত পাকের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিতে জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন। মায়ের উদরে মানুষের অবয়ব সৃষ্টি করে তিনি রুহ দ্বারা জীবিত করেন এবং দুনিয়াতে একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাকে রেখে অতঃপর মৃত্যু ঘটান। কিয়ামতের পর সব মানুষকেই তিনি পুনর্বার অস্তিত্ব দান করবেন এবং সবাই হাশরের মাঠে ছুটে যাবে। সেখানে বিচারের পর কাউকে তিনি বেহেশত দান করবেন, আবার কাউকে দান করবেন দোজখ। আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি মানুষের অতি সন্নিকটে আছেন। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষের প্রাণরগের চেয়ে নিকটে আছি।’ (সূরা কাফ, আয়াত-১৬) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমরা যেখানে যাও আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সাথে আছেন। (সূরা হাদিদ, আয়াত-৪)
তিনি কিভাবে আছেন মানুষকে জানানো হয়নি। সুতরাং সে বিষয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তিনি আছেন এই বিশ^াসই যথেষ্ট। কেউ কেউ বলেন উপরে আল্লাহ নিচে আপনি- এরকম বললে কঠিন গোনাহ হয়। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত বিশ^জগতের সৃষ্টিকর্তা এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি পালনকর্তা এবং তাঁরই আদেশে প্রত্যেক বস্তু ও প্রাণীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর হুকুম অমান্য করার সাধ্য কারো নেই। তাঁর ইচ্ছা ও হুকুমে সবার সৃষ্টি, অস্তিত্ব ও অবসান ঘটে। মানুষের সব চাওয়া-পাওয়া ও বেঁচে থাকা আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানির ওপর নির্ভরশীল।
সুতরাং আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র উপাস্য। আর কেউ বা কিছু ইবাদত পাওয়ার এতটুকু যোগ্যতা রাখে না। তাই কেউ আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে কাউকে শরিক করলে বা তাঁকে ছেড়ে অন্য কাউকে ইবাদত করলে কঠিন শিরক ও কুফর গোনাহে সে নিমজ্জিত হবে। নবী-রাসূল, পীর-মাশায়েখ, আলেম, ওলি, দরবেশ- কেউই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য নয়, অন্যান্য সব মানুষের মতো তারাও আল্লাহ তায়ালার বান্দা বা গোলাম। তারা কেউ কিছুই দিতে পারেন না, কেবল দিতে পারেন আল্লাহ তায়ালা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ সরকার