বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ডলারের মূল্যের প্রতিফলন হচ্ছে না বাজারে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলো পণ্য আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০ থেকে ১১ টাকা বেশি দামে ডলার কিনছে। গতকালও প্রতি ডলারে ৮০ পয়সা মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া মূল্য বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৮৭ টাকা। যদিও বাজারে এ দরে কেউ ডলার লেনদেন করতে পারছে না। গতকালও বেশ কিছু ব্যাংক ৯৬ থেকে ৯৭ টাকা দরে ডলার কিনে আমদানি দায় পরিশোধ করেছে। এ দিকে দফায় দফায় ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়। যার প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত দুই মাসে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে ডলারের মূল্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে যে পরিমাণ ডলার সরবরাহ হওয়ার দরকার তা হচ্ছে না। প্রতি মাসেই প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার সরবরাহ কম থাকছে। আর এ ঘাটতির একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে নগদে বিক্রি করে মেটানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ওপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সরবরাহ করেছে। যেভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ছে সরবরাহের দিকে বড় উন্নতি না হলে সামনে ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে। যার প্রভাব নিত্যপণ্যের ওপর পড়বে। কারণ বেশি দামে পণ্য কেনা হচ্ছে। আজকে যে পণের এলসি খোলা হচ্ছে তা পরিশোধে ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। আর এতে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে তা ঠিক আছে। কারণ একবারে বেশি হারে বাড়ালে বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। তবে বাজারের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবিষ্যতে বাজার বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে এটাই তাদের প্রত্যাশা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে বেশি হারে কেন ডলার বিক্রি হচ্ছে, এ বিষয়ে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু যে হারে বেড়ে গেছে সেই হারে সরবরাহ হচ্ছে না। এ কারণেই বেশি দরে ডলার কিনে আমদানি দায় পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে কিনাÑ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেশি দামে পণ্য কিনে কেউ কম দামে বিক্রি করবে না এটাই স্বাভাবিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ দুই বছর করোনার প্রাদুর্ভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়াও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয়। এতে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। ৭০ ডলার ব্যারেল জ্বালানি তেল এখন ১০০ ডলারের ওপরে উঠে গেছে। সেই সাথে বেড়ে গেছে এলএনজির দাম। এর প্রভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি ভোজ্যতেল রফতানি বন্ধ করে দেয় উৎপাদনকারী কয়েকটি দেশ। এর প্রভাবে বেড়ে যায় ভোজ্যতেলের দাম। এর রেশ কাটতে না কাটতেই প্রতিবেশী দেশ ভারত গম রফতানি বন্ধ করে দেয়। এতে এমনিতেই বাজারে সবধরনের পণ্যের দাম ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এর ওপর উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ডলারের অব্যাহতভাবে মূল্য বেড়ে যাওয়া। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পর সেই অনুযায়ী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রফতানি আয় না বাড়ায় ডলারের ঘাটতি বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই মাসে (মার্চ-এপ্রিল) রেকর্ড আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) দায় পরিশোধ করতে হয়েছে। এশিয়ার দেশগুলো থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয় তা থেকে রফতানি আয় বাদ দিলে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তাই হলো আকুর দায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুই মাসে (মার্চ-এপ্রিল) আকুর দায় পরিশোধ করতে হয়েছে ২২৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। একই সাথে সামগ্রিক আমদানি দায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বছর খানেক আগেও যেখানে সামগ্রিক আমদানি দায় পরিশোধ করতে হতো সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার থেকে চার বিলিয়ন ডলার। এখন তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেও যেখানে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার, গত মার্চে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার। সবমিলে জুলাই-মার্চ পর্যন্ত অর্থ বছরের ৯ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ছয় হাজার ৬৫০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চরা হাজার ৬৭৬ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ অস্বাভাবিক আমদানির দায় পরিশোধ করতে গিয়েই ডলারের টান পড়েছে।
এর বিপরীতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ আয় হয়েছে তার পার্থক্য রয়েছে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার কারণেই ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো ডলারের জন্য ছোটাছুটি করছে। প্রয়োজনীয় ডলার বাজার থেকে সংগ্রহ করতে না পারায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করছে। তবে অতীব প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির দায় মেটানোর ক্ষেত্রেই কেবল ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান করতে না পেরে ব্যাংকগুলো বাড়তি মূল্য বিকল্প উপায়ে ডলার কিনছে।
বেশি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করায় সবশ্রেণীর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় পণ্যের মূল্যের ওপর। আবার এখন যে পণ্য বাড়তি মুল্যে আমদানি করা হচ্ছে তার প্রভাব সামনের মাস ও পরের মাসে পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে এটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। গতকাল সোমবার এক অনুষ্ঠানে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির বাড়তি ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। কারণ বিশ্ববাজারে বৃদ্ধি পাওয়া উচ্চমূল্যের পণ্য বাংলাদেশে এখনো আসেনি। সেই পণ্য দেশে এলে দাম আরো বাড়বে। পাশাপাশি টাকার বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন হতে থাকলে অবশ্যই আমদানি করা সুদের পণ্যের দাম বাজারে আরো বেশি হবে। মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্রীয় সূচক হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়ে আগামী বাজেটে এটিকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তিনি।