দেশে ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়া চলছে ধীরগতিতে। গমের মজুদও তলানিতে। তবু মন্ত্রীরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ আছে, সঙ্কট হবে না। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ গম আমদানি করা হতো রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধে দেশ দুটি থেকে আমদানি বন্ধ। প্রতিবেশী ভারতও গম রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে আমাদের গমের মজুদ এখন তলানিতে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত বছর এ সময় গমের মজুদ ছিল দুই লাখ ৮৭ হাজার টন। এ বছর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গম মজুদ আছে এক লাখ দুই হাজার টন। বিশ্বজুড়ে খাদ্যসঙ্কটে এ সময়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টন গম মজুদ রাখা জরুরি। গত বছর ধান মজুদ ছিল ২০ লাখ টন। এ বছর মজুদ আছে তিন লাখ টন ধান। চাল মজুদ আছে ১০ লাখ ৩১ হাজার টন। এমন তথ্য থাকার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কিভাবে দাবি করা হয়, দেশে খাদ্যশস্যের সঙ্কট হবে না। লক্ষণীয়, গমের মজুদ সব সময় দেশে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্যশস্য উৎপাদনের তথ্যে বেশ ফারাক দেখা যায়। বিবিএস বলছে, গত অর্থবছর খাদ্যশস্য (চাল, গম ও ভুট্টা) উৎপাদন হয় চার কোটি ২৮ লাখ ৯ হাজার টন। অন্য দিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য, গত অর্থবছর মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে চার কোটি ৬৮ লাখ ২৯ হাজার টন। সে হিসাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন নিয়ে সরকারি এ দুই সংস্থার তথ্যে ব্যবধান ৪০ লাখ ২০ হাজার টন। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাস্তবে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে গম আমদানি করা হয়। এখন প্রতি বছর দেশে গড়পড়তা গম আমদানির পরিমাণ ৫০-৬০ লাখ টন। দু-একবার কিছু চাল রফতানি করা হয়েছে। তবে কয়েক বছর পরপর ফের চালও আমদানি করা হয়। দেশে চাল উৎপাদনের তথ্য কতটুকু ঠিক, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে। সরকারের তথ্যানুযায়ী, জনসংখ্যার নিরিখে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে। একদিকে বলা হচ্ছে, রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন, অন্য দিকে আমদানি বন্ধের খবরে আছে হাপিত্যেশ। কিন্তু চাহিদা, উৎপাদন ও মজুদের সঠিক তথ্য না থাকলে সরকার কিভাবে বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করবে তা স্পষ্ট নয়। যেখানে সরকারের জানাই নেই দেশে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় এবং প্রকৃত চাহিদা কত!
এই মুহূর্তে ইউক্রেনে মস্কোর আগ্রাসন এবং রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় উভয় দেশ থেকে সার, গম এবং অন্য পণ্যদ্রব্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। যা খাদ্য, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। যুদ্ধরত এই দুই দেশে বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম উৎপাদন হয়ে থাকে। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের বরাতে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যুদ্ধের কারণে শস্য ও সারের ঘাটতি এবং উষ্ণ তাপমাত্রা ও মহামারীতে পণ্যদ্রব্য সরবরাহ সমস্যা লাখ লাখ মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ফেলার হুমকি সৃষ্টি করেছে। খাদ্যসঙ্কটে অপুষ্টি, ক্ষুধা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে এবং এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
সবার মতো আমরাও মনে করি, সরকারের যদি তথ্য নিয়ে ধোঁয়াশা থাকে তাহলে সুযোগসন্ধানীরা সেই ফাঁকে আখের গোছায়। সঙ্গত কারণে এমন শঙ্কা হওয়া স্বাভাবিক, দেশে ধান, চাল, গমসহ সব খাদ্যপণ্যের দাম আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে খোলাসা করতে হবে কিভাবে গমের মজুদ পূরণ হবে। ধান-চাল কত দ্রুত সংগ্রহ হবে। তবে এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, সঙ্কট কাটাতে খাদ্যশস্য মজুদে শুধু স্থানীয় উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ঘাটতি পূরণে আমদানিও করতে হবে। অবশ্যই তা হওয়া উচিত নির্ভুল তথ্যের ভিত্তিতে।