শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০০ পূর্বাহ্ন

যাত্রা ও পালাগান এখন ইতিহাসের পাতায়

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২
  • ১৬৩ বার

আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য যাত্রা ও পালাগান। বাঙালির অন্যতম বিনোদনের খোরাকও বলা যায় এই শিল্পকে। ১৯৯০ সালের দিকে গ্রাম-গঞ্জের পাশাপাশি শহরের মানুষজনের মনেও স্থান করে নিয়েছিল এই ঐতিহ্যটি। গ্রাম-গঞ্জের পাশাপাশি শহরের হাজারো স্থানে এর আসর বসত, বিশেষ করে রাতে। এ ছাড়াও গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন বাড়ির উঠনেও রাতভোর পর্যন্ত চলত এই আয়োজন। ‘সোহরাব রুস্তম’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘মা মাটি মানুষ’, ‘বিজয় বসন্ত’, ‘কমলার বনবাস’, ‘রহিম রুপবান’, ‘চাদ সুলতানা’, ‘টিপু সুলতান’সহ অসংখ্য যাত্রাপালায় বুঁদ হয়ে থাকত লক্ষ-কোটি দর্শক। আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গানে গানে দর্শক মাতাতে পালাগানে জুড়ি মেলা ভার।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সাড়ে তিন দশক পর ইংরেজশাসিত বঙ্গদেশে বাংলা নাট্যাভিনয়ের সূচনা করেন রুশ নাগরিক হেরাসিম লেবেডেফ। সে সময়ে গ্রামেগঞ্জে রাতবিরাতে যাত্রাগানের আসর বসত। এরপর থেকেই বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে এই সংস্কৃতি মিশে যায় ওতপ্রোতভাবে।

কিন্তু কালের বিবর্তনে যাত্রা ও পালাগান এখন যেন আবার ইতিহাসের পাতায় চলে যাচ্ছে। এই সময়ের ছেলেমেয়েরা হয়তো জানেই না এই শিল্পটি সম্পর্কে। আর দিনকে দিন যেন বাংলার বুক থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্য।

এখন শহরের তেমন কোথাও যাত্রা ও পালাগানের আসর বসে না বললেই চলে। আর গ্রামে যে ক’টি হয় তাও হাতে গোনা। এর মধ্যেও আছে নানা জটিলতা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রশাসনিক ও স্থানীয় প্রভাবশীল ব্যক্তিদের বাধা এবং এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারীদের উপর কুনজর দেওয়া। আবার এই সংস্কৃতির মধ্যেও ঢুকে পরেছে অশ্লীলতা। তাই অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এই শিল্পের প্রতি।

বিষয়টি নিয়ে অনলাইন থেকে যোগাযোগ করা হয় যাত্রাশিল্পী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে’র সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘দিন দিন এই শিল্প ধ্বংসের পথে। অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও পশ্চিমা সংস্কৃতি কুপ্রভাব। এক শ্রেণির পুঁজিবাদী চক্র আমাদের সংস্কৃতিটাকে বিভিন্ন কৌশলে, বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতিটাকে কুঙ্ক্ষিগত করেছে এবং নষ্ট করে দিয়েছে। আর যারা নষ্ট করেছে তারা কিন্তু এদেশেরই সন্তান কিন্তু তারা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। আমাদের এই সংস্কৃতি ও নাটক সম্পর্কেও তাদের অভিজ্ঞতা নাই বললেই চলে।’

পালাগানের আসর। ছবি : সংগৃহীত

 

এই নেতা বলেন, ‘যেহেতু শিল্পটা দূর্বল আর যে কোন দূর্বল শিল্পকে অবলম্বন করে এক শ্রেণি-গোষ্ঠী জন্ম নেয়। যারা বিকৃতি রুচি সম্পন্ন এবং তারা অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যায়। এই শিল্পটা যেহেতু দূর্বল তাই তারা এগুলো করতে সাহস পায়। যেমন আমি সরাসরি বলি, যেমন যাত্রার- যাত্রা হলে এখন অশ্লীল নাচগান শুরু হয়। কিন্তু এটা আগে হতো না, ১৯৯৯ সালের পরে থেকে এটা শুরু হয়। আগে ছিল সুন্দর গল্পের নাটক। অথচ এই যাত্রা শিল্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত ও সংস্কার হয়েছে। যাই হোক, যদি সরকারি তদারকি থাকত ও পৃষ্ঠোপোষকতা থাকত তাহলে কিন্তু এমনটা হতে পারতো না। এছাড়াও আমরা দেখেছি, যাত্রা শুরু হলে প্রশাসনের এক শ্রেণীর অসৎ লোক আসে তারাই নাচ দেওয়ার জন্য আবদার করেন। যাত্রা কীভাবে হবে যারা এটাকে অনুমতি দেয়, তারাই তো এখন এটাকে অনুমতি দিচ্ছে না।’

ক্ষোভ নিয়ে মিলন কান্তি দে বলেন, ‘যদি আমরা সবাই এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি, তবেই এটা বেঁচে থাকবে, উজ্জ্বীবিত হবে। কিন্তু সরকার ও সবার মধ্যে যদি আগ্রহ না থাকে, তবে আমি-আপনি চেষ্টা করেও এটাকে বাঁচানো সম্ভব না। আর সরকারি ভাবে কোনো অর্থায়ন নেই। আর এই শিল্পের জন্য আলাদা কোনো অর্থায়নের শাখাও নেই। তবে কারোনাকালীন কিছু সংখ্যক শিল্পীরা নামমাত্র মূল্যে সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু এই যাত্রা শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট কোনো কোঠা নেই।’

যাত্রাশিল্পী উন্নয়ন পরিষদের এই নেতা আরও বলেন,‘আমরা কিছুদিনের মধ্যেই জোর আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছি। আগামী ৪ জুন আমাদের একটা সম্মেলন আছে। সেখান থেকেই আমরা লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দেবো। প্রেসক্লাব ও জাদুঘরের সামনে প্রতিদিন নাচ, গান, যাত্রা, নাটক হবে। আমাদের দাবি হচ্ছে, ৫০ বছরের মধ্যেও এদেশে একটি জাতীয় যাত্রামঞ্চ হলো না কেন? আর যাত্রাশিল্পীদের জন্য পৃথক কোঠা চালু করতে হবে। যেখান থেকে সরকারি ভাবে এই শিল্পে ও শিল্পীদের সাহায্য ও অর্থায়ন আসবে।’

যাত্রাদলের নায়ক চরিত্রের অভিনেতা ওয়াসিম বলেন, ‘সরকার এখন যাত্রার জন্য অনুমতি দিচ্ছে না। সংসার চলছে কষ্টের ওপরে। মাঝে মধ্যে বাইরের কিছু অনুষ্ঠান করি এবং অন্যদের ওখানে কাজও করি। আর সরকারি ভাবে কোন সাহায্য-সহযোগিতা নেই বললেই চলে। দেশে এখন সবই হচ্ছে, হচ্ছে না শুধু যাত্রাটাই। এভাবেই জীবন চলছে।’

যাত্রাদলের নায়িকা চরিত্রের অভিনেত্রী মুক্তি রানী চক্রবর্তী বলেন, ‘যাত্রা তো এখন আর নেই। খুব অর্থ কষ্টে আমরা দিন যাপন করছি। বলা যায়, আমরা শেষ হয়ে গেছি। না পারছি মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইতে, না পারছি ঘরে থাকতে। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি। আমাদের অনেকেই এই পেশা থেকে বেরিয়ে এখন অন্য পেশায় চলে গেছে। আমার একটা ভাই মারা গেছে, তার চিকিৎসাও ঠিকমতো করতে পারিনি। অন্যের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এখন আমাদের চলতে হচ্ছে। করোনার দুই বছরে শিল্পকলা থেকে দুবার ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু সেটি দিয়ে আমাদের কি হয়। আমরা যদি ঠিকমতো যাত্রা করতে পারি, তাহলে কিন্তু কারো কাছে আমাদের হাত পাততে হয় না। বর্তমান সরকার কিন্তু সাংস্কৃতিমনা সরকার। তারা কিন্তু অর্থ দিয়ে ইতিমধ্যেই শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শিল্পকলা থেকে কিভাবে কি হয় তা আমার জানা নেই। শিল্পকলার লাকী ভাই (মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী) যদি একটু সুনজরে তাকাতো, তাহলে আমরা এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরে ভালোভাবে চলতে পারতাম।’

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী’র মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com