উত্তর-পশ্চিম দিকে থেকে আসা হিমালয়ের হিমেল কনকনে হাওয়া ও ঘন কুয়াশায় সর্বত্র মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। পৌষ মাসের প্রথম তিন দিন পর টানা প্রায় তিন সপ্তাহেরও বেশি দিন ধরে শীতের দাপটে দেশজুড়ে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, কর্মজীবী মানুষের আয়-রোজগার ও কর্মচাঞ্চল্য, মালামাল ডেলিভারি পরিবহন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি-খামারসহ সর্বক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রায় মাসজুড়ে শীতকষ্টে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দিনে এনে দিনে খাওয়া হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষজন। সকালবেলায় শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের স্কুল-মাদরাসায় আসা-যাওয়া ব্যাহত হচ্ছে। আবার অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
রাতে-দিনে তীব্র শীতের কাঁপন এখন দেশজুড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে থমকে গেছে স্বাভাবিক জনজীবনের গতি। কুয়াশার সাথে ধূলোবালু, ধোঁয়ায় দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্দি-কাশি, ভাইরাস জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে মানুষ ঘরে ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডাক্তারের চেম্বারে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর ভিড়। সড়ক-মহাসড়ক, নৌ ও রেলপথে যানবাহনের গতি থমকে গেছে। বেড়েছে ঝুঁকি। আকাশপথেও বিলম্বে ছাড়ছে ফ্লাইট। সর্বত্র মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট ও অপচয় ঘটছে বৈরী আবহাওয়ায়।
আবহাওয়া বিভাগ বলছে, শীত ও কুয়াশার একটি বলয় অর্থাৎ উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ এখন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও এর সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। এর ফলে রাতের তাপমাত্রার তুলনায় অনেক জায়গায় দিনের তাপমাত্রা কমে গেছে এবং শীতের দাপট হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রংপুর বিভাগের রাজারহাটে ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় একে বলা হয় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। কিন্তু গত দুই দিন ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় দিনের (সর্বোচ্চ) তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পতন, ঘন কুয়াশা, মেঘলা আকাশ, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হিমেল কনকনে হাওয়া প্রবাহিত হওয়াÑ এসব কারণে প্রায় সারা দেশে তীব্র শীতে মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা জানান, এখানে ঘন কুয়াশার আড়ালে ঢাকা সূর্য। রোদের খুব একটা দেখা নেই। হাড় কনকনে অসহ্য হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। দিনের তাপমাত্রার পারদও নেমে গেছে রাতের তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি। চুয়াডাঙ্গায় দুই-তিন দিন ধরে দিন এবং রাতের বেলায় তাপমাত্রার পার্থক্য কমে গেছে খুবই অস্বাভাবিক পর্যায়ে। গত রোববার চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাঢ় কুয়াশা ও আকাশ মেঘলা, সেই সাথে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে হাড় কনকনে হিমেল হাওয়া বইছে চুয়াডাঙ্গায়। এ অবস্থায় চুয়াডাঙ্গার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দিনের বেলায়ও কাঁপছে মানুষ ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতায়। যা কয়েকদিন অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে দ্বিতীয় দফার নতুন করে শৈত্যপ্রবাহ ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অব্যাহত থাকায় জনজীবন কাহিল হয়ে পড়েছে। গতকাল সোমবার ভোররাত থেকে টিপটিপ বৃষ্টির মতো প্রচণ্ড ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানায়, সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা গত কয়েকদিনের চেয়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। তবে আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় কাতর হয়ে পড়েছে এখানকার খেটে খাওয়া মানুষগুলো। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষজনসহ শিশু ও বৃদ্ধরা চরম বিপাকে পড়েছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না পশু পাখিরাও। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৪ জনেরও বেশি ডায়রিয়া রোগী।
শিবচর (মাদারীপুর) সংবাদদাতা জানান, ঘন কুয়াশার কারণে ৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে ফেরি চলাচল গতকাল সকাল ৮টায় শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ফেরি বন্ধ থাকায় মাঝ পদ্মায় ও ঘাট এলাকায় আটকে পড়ায় যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা ভোগান্তি পোহান।
জানা যায়, গত রোববার সন্ধ্যা নামার পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে কুয়াশার প্রকোপ বাড়তে থাকে। কুয়াশার পূরত্ব বেড়ে সিগন্যাল বাতি, মার্কিং পয়েন্ট অস্পষ্ট হয়ে উঠলে দুর্ঘটনা এড়াতে রাত ১০টায় ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় ছয়টি ফেরি মাঝ নদীতে নোঙর করতে বাধ্য হয়। এ সময় মাঝ পদ্মা ও ঘাট এলাকায় আটকে পড়ে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা প্রচণ্ড শীতে চরম দুর্ভোগ পোহান। প্রায় ৯ ঘণ্টা ঘণ্টা পর কুয়াশার প্রকোপ কমলে সোমবার সকাল ৭টা থেকে ফেরিসহ নৌযান চলাচল শুরু হয়। ফেরি বন্ধের কারণে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ঘাট ও মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ছয় শতাধিক ছোট-বড় যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় আটকে উভয় ঘাটে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ফেরি ঘাটের ব্যবস্থাপক আবদুল আলীম মিয়া বলেন, কুয়াশার তীব্রতার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে রাত ১০টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। কুয়াশার তীব্রতা কমলে সোমবার সকাল ৭টা থেকে ফেরিসহ নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। আমরা যাত্রীবাহী পরিবহন ও কাঁচামালবাহী ট্রাক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপার করছি।
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম নৌপথ শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে গত রোববার ভোর ৮টা থেকে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। এর আগে রোববার রাত ১০ থেকে গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় ১০ ঘণ্টা। প্রতিদিনের মতো ঘন কুয়াশার কারণে বকে ফুট অদূরে দিক মার্ক না দেখার কারণে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ফেরি মাস্টাররা তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ ফেরি চলাচল বন্ধ রাখেন।
মাওয়া বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক মো: শফিক আহম্মেদ জানান, বর্তমানে ১৪টি ফেরি দিয়ে পারাপার চলছে। ঘাট এলাকায় দুই শতাধিক ছোট বড় যানবাহন পারাপারের অপেক্ষমাণ রয়েছে।