নবী-রাসূলের মধ্যে হজরত ইবরাহিম আ: অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সাতজন নবী-রাসূল ছাড়া সব নবী-রাসূল তাঁর বংশ থেকে এসেছেন। তিনি মুসলমানদের জাতির পিতা। ইবরাহিম সুরিয়ানি ভাষার শব্দ। অর্থ আবে রাহিম-দয়ালু পিতা। শিশুদের প্রতি দয়ালু হিসেবে খ্যাত ছিলেন বলে তিনি এ নামে ভূষিত হন। আর এ কারণে পরকালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী মুমিনদের অপ্রাপ্ত বয়সে মৃত সন্তানদের দায়িত্বশীল হবেন। (তাফসিরে কুরতুবি প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩)
ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমান সবাই তাকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করে। তিনি সর্বপ্রথম মুসলমান নাম রাখেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, (তোমরা প্রতিষ্ঠিত থেকো) তোমাদের (জাতির) পিতা ইবরাহিমের দ্বীনের ওপর, সে আগেই তোমাদের মুসলিম নাম রেখেছিল, এর (কুরআনের) মধ্যেও (তোমাদের এ নামই দেয়া হয়েছে) যেন, (তোমাদের) রাসূল তোমাদের (মুসলিম হওয়ার) ওপর সাক্ষ্য দিতে পারে, আর তোমরাও (দুনিয়ার সব) মানব জাতির ওপর (আল্লাহর দ্বীনের) সাক্ষ্য দিতে পারো। (সূরা হজ-৭৮) হজরত ইবরাহিম আ: সর্বপ্রথম খাতনা করেন, প্রথম মেহমানদারির প্রথা চালু করেন, প্রথম নাভীর নিচের পশম মুণ্ডান, নখ কাটেন, গোঁফ খাটো করেন এবং তাঁরই প্রথম চুল পাকে। তিনি পাকা চুল দেখে আশ্চর্য হয়ে বলেন, হে আল্লাহ! এটা কী? আল্লাহ বলেন, তা সম্মানের প্রতীক। তিনি প্রথম মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়েছেন, সর্বপ্রথম ছারিদ (রুটি ও গোশতের সংমিশ্রণে তৈরি বিশেষ খাদ্য) খেয়েছেন, প্রথম তরবারি দিয়ে শত্রুকে আঘাত করেন, মিসওয়াক করার প্রথা, ইসতেনজা করার প্রথা এবং পায়জামা পরার রীতি চালু করেন (মুয়াত্তা, কুরতুবি পঞ্চম খণ্ড, পৃৃষ্ঠা-৭৫) হজ ও কোরবানি হজরত ইবরাহিম আ:-এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইবরাহিম আ:-এর প্রতি নির্দেশ : ইবরাহিম আ: ও ইসমাঈল আ: কর্তৃক কাবাঘর পুনর্নির্মিত হওয়ার পর আল্লøাহ তায়ালা ইবরাহিম আ:-কে তিনটি নির্দেশ দেন। যেমন- আল্লাহর বাণী, ‘যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লøাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না ও আমার গৃহকে পবিত্র রাখো তাওয়াফকারী, নামাজ আদায়কারী এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটের পিঠে সাওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।’ (সূরা হজ : ২৭-২৮)
হজের ঘোষণা : ইমাম বগভি র. বলেন, কাবাঘর নির্মাণ করার পর আল্লাহ তায়ালা আদম আ:-কে নির্দেশ দেন যে মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, বায়তুল্লøাহর হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। ইবনে আবি হাতেম ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন, যখন ইবরাহিম আ:-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করেন, এখানে তো জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তর। ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই, যেখানে জনবসতি আছে, সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা। মানুষের কানে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এরপর ইবরাহিম আ: আবু কুবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বাঁয়ে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করে চিৎকার করে ঘোষণা করেন, ‘হে মানুষ! আল্লাহ তোমাদের এ ঘরের হজ করার নির্দেশ করেছেন, যাতে তোমাদের জান্নাত দিতে পারেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিতে পারেন। সুতরাং তোমরা হজ করো।’ ইবরাহিম আ:-এর এ আওয়াজ আল্লাহ তায়ালা সব মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। এমনকি যারা ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আসবে, তাদের কানে পর্যন্ত এ আওয়াজ পৌঁছে দেয়া হয়। যাদের ভাগ্যে আল্লøাহ তায়ালা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এ আওয়াজের জবাবে- লাব্বাইক, লাব্বাইক (আমি হাজির, আমি হাজির) বলে হাজির হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ইবরাহিম আ:-এর ঘোষণার উত্তরই হচ্ছে হজে লাব্বাইক বলার আসল ভিত্তি। (কুরতুবি, ১২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮, মাজহারি) ইবরাহিম আ:-এর ঘোষণাকে সব মানবমণ্ডলী পর্যন্ত পৌঁছানোর কারণে কিয়ামত পর্যন্ত হজের ধারা কায়েম থাকবে।
পুত্রকে কোরবানি : হজরত ইবরাহিম আ:-এর জন্য তখনই সবচেয়ে বড় ও কঠিন পরীক্ষা হয় যখন ইসলাম তাঁর হাতে তুলে দেয় ধারালো ছুরি, যেন তিনি প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে জবেহ করে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য সব কিছুকে কোরবান করে দেন। আর হজরত ইসমাঈল আ:-এর মস্তক অবনত করে দিয়েছিল, যেন তিনি আল্লাহ তায়ালার রাহে স্বীয় জীবন বিসর্জন দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে আল্লাহর নামে জবেহ করছি, অতএব এ প্রসঙ্গে তোমার কি মত জানাও, হজরত ইসমাঈল আ: (প্রত্যুত্তরে) বলেন, হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে তা আপনি পালন করুন। ইনশা আল্লøাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। (সূরা আস সাফফাত-১০২)
যখন পিতা পুত্রকে জবেহ করার জন্য উদ্যত হলেন, তাকে মাটিতে শোয়ালেন, তখন এ কাজ ইসলামের হাতই করেছিল। ইসলামের শিক্ষার কারণেই হজরত ইসমাঈল আ: নিজেকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেন। হজরত ইবরাহিম আ:-এর অন্তরে একই সাথে আল্লøাহর প্রেম এবং পুত্রের প্রতি অনুরাগ অবস্থান করবে, আল্লাহ তা পছন্দ করেননি। এভাবেই হজরত ইসমাঈল আ:-এর অন্তরে স্বীয় প্রাণের মায়া বাসা বেঁধেছে দেখে তিনি তাও সহ্য করেননি। ফলে আল্লাহ তায়ালা এ আদেশ দেন, ‘সর্বপ্রথম প্রেমের স্থান অন্তরকে শুধু আমার জন্য খালি করো। অন্তরে শুধু আমারই প্রেম ও ভালোবাসায় ভরপুর থাকবে। অন্য কেউ এখানে ভাগ বসাতে পারবে না।’ বিশ্ব প্রতিপালকের প্রেমের কি বৈশিষ্ট্য যে, প্রেমের পবিত্র গৃহের যাবতীয় সাজসজ্জা কেবল প্রেমিকদের তাজা রক্ত দিয়েই করা হয়। পিতার হাতে ছুরি এ জন্যই দেয়া হয়, যেন প্রাণাধিক পুত্রকেই কোরবানি করে। আর পুত্রকেও এই নির্দেশ দেয়া হয়- সানন্দে আত্মসমর্পণ করো, নিজকে বিলীন করে দাও এবং জবেহ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।
এখানেই শেষ নয়, বরং জবেহ হওয়ার দিনকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দোৎসবের দিনও নির্ধারণ করা হয়েছে।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী