আমাদের দেশে খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়লেও স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য বেশির ভাগ জনগণের নেই। খাদ্য অনিশ্চয়তায় থাকা ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে না পারার প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যে, বিশেষ করে পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। দেড় দশক আগে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে আমাদের পুষ্টি পরিস্থিতি এখনো কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত হয়নি। অথচ নিরাপদ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পাওয়া প্রত্যেক মানুষের অধিকার। বাস্তবতা হলো ক্ষুধা নির্মূল, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সব ধরনের অপুষ্টি দূর করার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে আমাদের। অথচ কোভিড-১৯ মহামারী বৈশ্বিক ক্ষুধা ও খাদ্য অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। অনেক উন্নতির পরও শিশুদের অপুষ্টি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। মায়েদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
দেশে একজন মানুষের দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা। জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশেরই এ টাকা খরচ করে স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে স্বাস্থ্যকর খাবারে একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হতো ২৭২ টাকা ১৬ পয়সা। ওই সময় দেশের ১১ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। ২০২০ সালে দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবারে খরচ বেড়ে হয় ২৭৫ টাকা ৭৬ পয়সা। কিন্তু দেশের ১২ কোটি ১১ লাখ মানুষের দৈনিক ওই পরিমাণ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। এই সামর্থ্যহীন মানুষ মোট জনসংখ্যার ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
পাওয়া তথ্য মতে, দেশে ২০১৪-১৬ সময়কালে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল পাঁচ কোটি চার লাখ মানুষ। তিন বছর পর ২০১৯-২১ সময়কালে একই ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল পাঁচ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ এ অনিশ্চয়তায় ছিল। এ হিসাবে ৬৮ শতাংশ মানুষের খাদ্য বিষয়ে অনিশ্চয়তা নেই। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাস্থ্যকর খাবার খায় না বা খেতে পারে না।
জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বিভিন্ন সময়ের শিশুপুষ্টির যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কৃশকায় ও খর্বকায় শিশুর হার দিন দিন কমছে, তবে অস্বাভাবিক বেশি ওজনের শিশুর হার বাড়ছে আবার বয়স্ক মানুষের মধ্যেও বেশি ওজনের প্রবণতা বাড়ছে। ২০১২ সালে অস্বাভাবিক ওজনের মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে বেড়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।
নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতির কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২০১২ সালে ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৩৬ শতাংশের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ছিল। ক্রমে এ হার কমে আসার কথা থাকলেও ২০১৯ সালে একই বয়সী নারীদের ৩৭ শতাংশের এ সমস্যা ছিল।
দেশে পুষ্টির অগ্রগতি হলেও করোনা মহামারী বৈশ্বিকভাবে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এ পরিস্থিতিকে আরো খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার ও টেকসই কৃষি খাদ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এখানে বিনিয়োগের অর্থ হলো- আগামী প্রজন্মের জন্য বিনিয়োগ করা।
লক্ষণীয়, দেশের কৃষিতে উন্নতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অনেক কৃষক প্রধান খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে অন্য সব কৃষিপণ্য উৎপাদনে বেশি আগ্রহী। বিশেষ করে অর্থকরী ফসল। এ ছাড়া প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি কৃষি খাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে আমাদের কৃষি খাতে পরিকল্পিত উন্নয়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। যাতে নিজেদের দেশের কৃষি থেকে প্রয়োজন অনুসারে প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপন্ন করা যায়। কেবল তখনই সম্ভব হবে সবার জন্য কাক্সিক্ষত মানের পুষ্টিসম্পন্ন খাবার আয়োজন।