এক দিকে কমছে রাজস্ব আদায়, অন্য দিকে বাড়ছে সরকারের ব্যাংক ঋণ। রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার কারণে এমন অবস্থা হয়েছে, সরকার পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণ নেয়ার লÿ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, মাত্র ছয় মাসে তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে। অন্য দিকে পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ২৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ঘাটতি মেটাতে সরকারকে অনেকটা নিরুপায় হয়ে ব্যাংকিং খাতের দিকে বেশি ‘হাত পাততে’ হচ্ছে। এতে করে বেসরকারি খাত ঋণপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়ার কারণেও সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ছে।
সূত্র জানায়, বাজেটে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেয়ার লÿ্যমাত্রা রয়েছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকেই ঋণ নেয়া হয়ে গেছে ৪৮ হাজার ১৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া হয়েছে একহাজার ৭৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় ১১৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা বেশি। এই হিসাবে প্রতি মাসে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেয়ার পরিমাণ ছিল ৮ হাজার কোটি টাকা এবং প্রতিদিন হিসেবে তা ৫৩ কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা বিশেøষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) জুলাই-ডিসেম্বর (ছয় মাসে) সময়কালে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছিল ৪৪ হাজার ৬২০ কেটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে একই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ তিন হাজার ৩৯৫ কোটি ৩৭ লাখ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ১৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ৬ ভাগ বেড়ে হয়েছে ১২ লাখ ১৬ হাজার ২০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কেন অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছে এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সময়ে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ ঋণও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির হার হচ্ছে ৩২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
অন্য দিকে চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৩ হাজার ৭০৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হার ৫ শতাংশ। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে টার্গেট থেকে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ২৮ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের একটি কৌশলগত লÿ্যমাত্রা থাকে। যেমন অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে তা কত আদায় করতে পারবে, ছয় মাসে কত আদায় করা যাবে। কারণ অর্থবছরে শুরুর দিকে পাঁচ-ছয় মাস রাজস্ব আদায় অনেকটা কম হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষে এসে এ আদায় অনেক বেড়ে যায়। এটি মাথায় রেখেই এনবিআর রাজস্ব আদায়ে তাদের লÿ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে। তিনি আরো বলেন, বাজেটের লÿ্যমাত্রা ধরলে পাঁচ মাসে রাজস্ব ঘাটতি অর্ধলাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যেমন চলতি অর্থবছরের বাজেটে এনবিআর থেকে রাজস্ব আদায়ে টার্গেট রয়েছে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু আদায় হয়েছে ৮৩ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে রাজস্ব ঘাটতি ৫২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলতি মাস থেকে বিভিন্ন ‘ইএফডি’ (ইলেট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) মেশিন বসানোর কাজ শুরু হবে। এর ফলে ভ্যাট আদায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আশা করা যাচ্ছে এর ফলে বছর শেষে রাজস্ব আদায়ের চাঙ্গাভাব আসবে। কিন্তু তা অবশ্যই বাজেটের টার্গেট পূরণ করার মতো নয়। কারণ এবার রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ৪০ ভাগ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে, যা আমাদের পÿ থেকে আদায় করা অসম্ভব। লÿ্যমাত্রা সংশোধন না করা হলে বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।