আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমিক মুমিনের জন্য কারবালার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। আরবি বর্ষপরিক্রমার প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখ মহানবী সা:-এর ওফাতের ৫০ বছর পর ৬১ হিজরিতে সংঘটিত হয় এ মর্মান্তিক ঘটনা। এ দিনে মহানবী সা:-এর প্রিয় নাতি ইমাম হুসাইন রা: ও তাঁর পরিবার এবং বংশের ৭২ জন নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
১০ মহররমে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলি : ১০ মহররমে ঘটেছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা।
যেমন- ১. মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম আ:-এর সৃষ্টি, তাঁকে জান্নাতে অবস্থান, পৃথিবীতে প্রেরণ ও তাওবা কবুল সবই ১০ মহররম সংঘটিত হয়।
২. হজরত নূহ আ:-এর নৌকা ৪০ দিন পর জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মাটি স্পর্শ করে ঐতিহাসিক ১০ মহররমে।
৩. এ দিনেই হজরত ইবরাহিম আ: জন্মগ্রহণ করেন, তাঁকে ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং নমরুদের অগ্নি থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
৪. হজরত ইদ্রিস আ:-কে বিশেষ মর্যাদায় চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয় এ দিনে।
৫. দীর্ঘ ৪০ বছর পর হজরত ইউসুফ আ:-এর সাথে তার পিতা ইয়াকুব আ:-এর সাক্ষাৎ হয়।
৬. হজরত আইয়ুব আ: দীর্ঘ ১৮ বছর কুষ্ঠরোগ ভোগ করার পর আরোগ্য লাভ করেছিলেন এ দিনে।
৭. ইউনূস আ: ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তিলাভ করেন এ দিনে।
৮. হজরত সুলায়মান আ: সাময়িক রাজত্বহারা হন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আবার রাজত্ব ফিরিয়ে দেন এ দিনে।
৯. আল্লাহ তায়ালা হজরত মূসা আ: ও তাঁর অনুসারী বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে পানির মধ্যে রাস্তা তৈরি করে দিয়ে পার করে দেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ লোহিত সাগরে ডুবিয়ে মারেন এ দিনে। হজরত মূসা আ: তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে কথা বলেছিলেন ১০ মহররমে।
১০. এ দিনে হজরত ঈসা আ:-এর জন্ম হয় এবং ইহুদিরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ফেরেশতা কর্তৃক সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন এ দিনেই। ১১. আশুরার দিবসেই মহানবী সা:-এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দেয়া হয়। ১২. পবিত্র কাবা শরিফে সর্বপ্রথম গিলাফ দিয়ে আবৃত করা হয়েছিল এ দিনে। ১৩. আশুরার দিনেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ, মর্তজগৎ, পর্বতরাজি, লওহ-কলম ও ফেরেশতাদের। ১৪. আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা নিজ আরশে আজিমে অধিষ্ঠিত হন। ১৫. আকাশ থেকে প্রথম বৃষ্টিপাত হয় এ দিনেই। ১৬. কিয়ামত সংঘটিত হবে মহররম মাসের ১০ তারিখ জুমাবার। ১৭. এ দিনে (নারীরা ছাড়া) সপরিবারে শহীদ হন বিশ্বনবী সা:-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন রা:।
নবী পরিবারের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার : ইসলামী সেনার সংখ্যা ৭২ থেকে ১১০ জনের মধ্যে কয়েকজন ছিল নওজোয়ান বাকিরা বৃদ্ধ, শিশু ও নারী। তারা একে একে ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। আর বীর বিক্রমে লড়াই করে অসংখ্য শত্রুকে জমালয়ে পাঠিয়ে দেন। অবশেষে নিজেরাও শাহাদাত বরণ করেন। ইয়াজিদ বাহিনী কারবালার ফোরাত নদীর পানি দখল করে রাখে, যাতে ক্ষুধা ও পিপাসায় ইমাম হোসাইন রা: ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান এবং সাথীরা কষ্ট পায়। যুদ্ধ চলাকালে তাঁবু থেকে শিশুর ক্রন্দন শুনে ইমাম ফিরে এসে দেখলেন ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য আলী আসগর তীব্র পিপাসায় ও ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে। তিনি শিশুপুত্রকে হাতে তুলে নিয়ে শত্রুদের একটু পানি দিতে বললেন। এ সুযোগে ইয়াজিদের সেনাপতি ওমর বিন সাদের নির্দেশে হুরমুলা নামের পাষণ্ড তীর ছোড়ে, শিশু আসগরের গর্দান পিতা হোসাইনের বাহু ভেদ করে তীরটি বেরিয়ে যায়। শিশু আসগর পিতার কোলেই শহীদ হন। দুশমনরা তাঁকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলে। বৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে থাকে তীর, বল্লøম, নেজা ইত্যাদি। অবশেষে অসংখ্য আঘাত ও জখমপ্রাপ্ত হয়ে ইমাম হোসাইন রা: অশ্বপৃষ্ঠ থেকে জমিনে পড়ে যান। পাষণ্ড সীমার এসে ইমামের মস্তক মোবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পবিত্র আহলে বায়াতের তাঁবু লুণ্ঠিত হয়। দলিত, মথিত করা হলো শহীদের লাশ। আর এভাবেই ইয়াজিদ বাহিনী হজরত ইমাম হোসাইনের ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন ও ক্ষুদ্রসংখ্যক ইসলামী বাহিনীকে ঘেরাও করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর কাছে যা ছিল সবই খুলে ফেলা হয়। এমনকি তাঁর লাশ থেকে কাপড়ও খুলে ফেলা হয়। পরে তাঁকে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ঠ করা হয়, মহিলাদের গায়ের চাদরও ছিনিয়ে নেয়া হয়। হজরত হোসাইন রা: ও অন্য শহীদদের পবিত্র মস্তক বিচ্ছিন্ন করে কুফায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রকাশ্যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়।
আশুরার দিনের আমল : হাদিস শরিফে ১০ মহররম রোজা পালনের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘রমজানের রোজার পর আল্লাহর কাছে মহররম মাসের রোজা ফজিলতের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠতম’ (মুসলিম-১/৩৮৮)। মহানবী সা: আরো বলেন, ‘আমি আল্লাহর দরবারে আশা রাখি যেন আশুরার রোজা আল্লাহর কাছে পূর্ববর্তী বছরের গুনাহের কাফফারাস্বরূপ গণ্য হয়’ (তিরমিজি-১৩২, ইবনে মাজাহ-১২৪)।
সহি বুখারি ও মুসলিম শরিফে সালামাহ ইবনে আকওয়া রা: থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী সা: বনি আসলাম গোত্রের এক লোককে নির্দেশ দেন, সে যেন লোকদের মাঝে এ ঘোষণা করে দেয়- আজ সকালে খেয়েছে সে যেন দিবসের বাকি অংশে রোজা পালন করে, আর যে ব্যক্তি সকালে কিছু খায়নি সে যেন রোজা রাখে। কেননা, আজ আশুরার দিন। আশুরার দিনে যেহেতু ইহুদিরাও রোজা রাখে তাই তাদের সাথে পার্থক্য করার জন্য রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো এবং এর আগে এক দিন অথবা পরে এক দিন রোজা রেখে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করো।’
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী