আরবি হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। ইসলামী পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবী সা:-এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন রা:-এর শাহাদাত এই দিনটিকে বিশ্ববাসীর কাছে সর্বাধিক স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।
মহররম অর্থ সম্মানিত। ইসলামী সন গণনায় মহররম মর্যাদাবান একটি মাস। মহররম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। এ মাসসহ আরো তিনটি মাস আছে যে মাসগুলোতে ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। বরকতময় ও ঐতিহাসিক দিবসগুলোর মধ্যে পবিত্র আশুরা হচ্ছে অন্যতম একটি দিবস। আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। আর আশুরা মানে দশম। অর্থাৎ মহররম মাসের ১০ তারিখ।
আশুরায় ঘটে যাওয়া কিছু ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা : ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজন প্রক্রিয়ার সূচনা হয় আশুরায়। হজরত আদম আ:-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও পৃথিবীতে অবতরণ, খলিফা নিযুক্ত করা আর জান্নাতে দাখিল ও পৃথিবীতে নির্বাসনের পর মক্কা মুয়াজ্জমার আরাফাত ময়দানে হজরত হাওয়া আ:-এর সাথে পরিচিত হওয়া এবং দীর্ঘ দিন ক্ষমা প্রার্থনা শেষে দু’জনের তাওবা কবুল করেন। হজরত মূসা আ: সমুদ্রপথে যাত্রা, হজরত নূহ আ:-এর নৌযানের যাত্রা শুরু এবং বন্যা-প্লাবনের সমাপ্তি আশুরাতেই ঘটেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল সা: আশুরায় কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আশুরা এলে তিনি বিনয়ে বিনম্র্র থাকতেন ও রোজা পালন করতেন (তাফসিরে তাবারি, মুহাম্মদ ইবনে জারির)।
আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা সাগর, পাহাড়, প্রাণিকুল, আসমান-জমিন ও লওহ-কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার এ দিনেই আরশে আজিমে সমাসীন হয়েছেন। তামাম মাখলুকাত ধ্বংসও হবে মহররমের ১০ তারিখে। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ড হাবিল-কাবিলের ঘটনাও এ দিনে সংঘটিত হয়। হজরত ইবরাহিম আ: ক্ষমতাশালী মূর্তিপূজারি নমরুদের অগ্নিকাণ্ড থেকে উদ্ধার হন এ দিনে, হজরত আইয়ুব আ: কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি পান এ দিনে, হজরত ইউনুছ আ: মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ এবং ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া আ: শিশুপুত্র মুস আ:-কে এ দিনই ফেরত পান। আল্লাহ পাক এ দিনে হজরত ইদ্রিস আ:-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানোর পর গুনাহ-অপরাধের জন্য কান্নাকাটি করলে আবার তাকে জান্নাতে ফেরত নেন। এ দিনই হজরত দাউদ আ:-এর গুনাহ মাফ হয়, হজরত মরিয়ম আ:-এর গর্ভ থেকে হজরত ঈসা আ:-এর পৃথিবীতে আগমন ঘটে। এ ছাড়া ইসলামের ইতিহাসের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এ দিনে।
আশুরার বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা : আশুরা হলো বছরের অন্যতম সেরা একটি ফজিলতপূর্ণ দিন। ইসলামপূর্ব যুগেও এ দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মদিনার ইহুদিরা ও মক্কার কোরাইশরাও এ দিনটিতে রোজা রাখত। রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় হিজরতের পর সেখানকার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা রাখতে দেখে তাদের কাছে এ দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলে তারা বলল- কারণ এ দিনে নবী মূসা আ: ও তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারী ও অবাধ্য ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছেন। আর তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি প্রতি বছর এ দিনে রোজা রাখতেন, তাই আমরাও তাঁর অনুকরণে এ দিনে রোজা রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন ‘আমরা (তোমাদের চেয়ে) মূসার অনুকরণের বেশি হকদার’ (বুখারি-মুসলিম)। এরপর থেকে তিনি আশুরার দিনে রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের নির্দেশ দিতেন।
নবী সা:-এর ওফাতের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর একই দিনে তাঁরই প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন রা: সপরিবারে ইরাকের কারবালায় ঘাতকদের হাতে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হন। মুসলিম মাত্রই এই ঘটনায় ব্যথিত ও মর্মাহত হতে বাধ্য। তবে সে কারণে রাসূলুল্লাহ সা: বর্ণিত আশুরার মূল তাৎপর্য কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। পরিতাপের বিষয় হলো- আশুরার দিনে ঘটে যাওয়া কারবালার নির্মম ঘটনাটির কথা আমরা জানলেও এই দিনের মূল ও হাদিস বর্ণিত (মূসা আ: ও বনি ইসরাইলের মুক্তির) ইতিহাস অনেকের কাছেই অজানা।
আশুরার দিনে কিছু করণীয় কাজ : আশুরার দিনে রোজা রাখা। তবে এর সাথে ৯ তারিখ বা ১১ তারিখ মিলিয়ে রাখা। সম্ভব হলে ওই দিনে যারা রোজা রাখবে তাদের এক বা একাধিকজনকে ইফতার করানো। সাধ্যমতো দান-সদকাহ করা। গরিবদের পানাহার করানো। ইয়াতিমের মাথায় হাত বুলানো ও তাদের সহযোগিতায় পাশে এসে দাঁড়ানো। নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখ। তবে এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের থেকে ভিন্নতা অবলম্বন করে তোমরা আশুরার আগে অথবা পরের একদিনসহ রোজা রাখবে’ (মুসনাদে আহমাদ-২৪১)।
এই দিন বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা। কারণ নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘মহররম হলো আল্লাহ তায়ালার (কাছে একটি মর্যাদাবান) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন’ (তিরমিজি-৭৪১)। দ্বীনের খাতিরে এই দিনে হজরত হুসাইন রা: যে ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শন করেছেন তা থেকে সব মুসলমানের দ্বীনের জন্য যেকোনো ধরনের ত্যাগ ও কোরবানি পেশ করার শিক্ষা গ্রহণ করা।
আশুরার দিনে কিছু বর্জনীয় কাজ : আশুরার সুমহান মর্যাদা ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে কিছু নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কারের প্রচলন হয়ে গেছে। সেসব থেকে বেঁচে থাকা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আশুরার দিন ক্রন্দন-বিলাপ করা, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা- কোনোটিই শরিয়তসম্মত কাজ নয়। কুরআন-হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই। আশুরার এই ঐতিহাসিক ঘটনার মূল চেতনা হচ্ছে- ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বর্তমান বিশ্বে আশুরার এই শিক্ষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালার ঘটনা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের দুনিয়ার অন্যায় ও অবিচার দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
তাজিয়া বানানো ‘হায় হুসেন’, ‘হায় আলী’ ইত্যাদি বলে বিলাপ ও মাতম করা এবং ছুরি মেরে নিজের বুক ও পিঠ থেকে রক্ত বের করা নাজায়েজ। এগুলো করনেওয়ালা, দর্শক ও শ্রোতা উভয়ের প্রতি নবী করিম সা: অভিসম্পাত করেছেন। কারবালার শহীদগণ পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদতবরণ করেছেন, তাই তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য বা অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এই দিনে লোকদের পানি ও শরবত পান করানো। হজরত হুসাইন রা: ও তাঁর স্বজনদের উদ্দেশে ইছালে সাওয়াবের জন্য বিশেষ করে এই দিনে খিচুড়ি পাকিয়ে তা আত্মীয়স্বজন ও গরিব মিসকিনকে খাওয়ানো ও বিলানো, একে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ যেহেতু নানাবিধ কুপ্রথায় জড়িয়ে পড়েছে তাই তাও নিষিদ্ধ ও নাজায়েজ।
আশুরার দিনে শোক পালন করা; চাই তা যেকোনো সুরতেই হোক। শরিয়ত অনুমোদিত শোক পালনের অর্থ হলো শুধু সাজসজ্জা বর্জন করা। শোক পালনের নাম যাচ্ছেতাই করার অনুমতি শরিয়তে নেই।
লেখক : মাওলানা ওবায়দুল হক, সভাপতি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি