পাকিস্তানের পরিস্থিতি এমন এক ক্রসরোডে এসে উপনীত হয়েছে যাতে দেশটির ভবিষ্যৎ গন্তব্য নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কয়েক দিন ধরে খবর প্রকাশ হচ্ছে পিটিআই নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তার চিফ অব স্টাফ শাহবাজ গিলকে রিমাণ্ডে নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগের মধ্যেই ইসলামাবাদের জেলা জজের আদালত তাকে আরো দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আর এই রিমান্ডের প্রতিবাদে ইসলামাবাদের বিশাল জনসমাবেশে ইমরান খান বিচারক ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দেন। এরপর ইসলামাবাদ হাইকোর্ট আদালত অবমাননার অভিযোগ তদন্তের জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেছে ইমরানের বিরুদ্ধে। এই উত্তেজনার মধ্যে পাঞ্জাবের উপনির্বাচনে জয়ী হবার পর করাচির জাতীয় পরিষদের একটি উপনির্বাচনেও ইমরানের দল জয়ী হয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে দেশটির জনমত এখন প্রবলভাবে ইমরান খান ও তার দলের পক্ষে। অন্য দিকে প্রভাবশালী অধিকাংশ দল ইমরান খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। প্রভাবশালী ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ হিসাবে পরিচিত সামরিক প্রতিষ্ঠান ইমরানের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে- এমন ধারণা সাধারণ মানুষের। বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট সরকারের মধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা ও মেয়াদ পূর্তির আগে দু’বার ক্ষমতা থেকে বিদায় করার জন্য এস্টাবলিশমেন্টের ভূমিকাকে দায়ী করেন দলটির নেতাকর্মীরা। আর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং জান্তা সরকারের সময়ে তার প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ জন্য দলটির নেতাকর্মীরা দায়ী করে সামরিক প্রতিষ্ঠানকে।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী বেনজীর ভুট্টো আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এ জন্যও তখনকার সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। যদিও এরপর ক্ষমতায় আসা আসিফ আলী জারদারি এস্টাবলিশমেন্টের সাথে সবসময় কাজের সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং সঙ্ঘাতের পথে যাননি। তবে সাধারণভাবে পিপিপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সামরিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী চেতনা দেখা যায়।
উপরের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বিপরীতে ইমরান খানের উত্থান এবং ২০১৮ সালে তার বিপুল বিজয় ও সরকার গঠনের পেছনে এস্টাবলিশমেন্টর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইমরানের পিটিআইকে জয়ী করার জন্য আঘাত শুধু নওয়াজ মুসলিম লীগের ওপরই করা হয়নি, সেই সাথে খায়বার পাখতুন খোয়া ও বেলুচিস্তানে তুলনামূলকভাবে ভালো প্রভাব রাখা অঞ্চলে মওলানা সিরাজুল হকের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী ও মওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাচনী ফলাফলে বিপর্যয় ঘটানো হয়। এই দুই দলের নেতারা এ জন্য এস্টাবলিশমেন্টের ভ‚মিকাকে দায়ী করেন। যদিও এই দলগুলোকে কোন সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য সামরিক প্রতিষ্ঠানকে শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে যারা বিবেচনা করে তাদের মধ্যে এ দলগুলোকে ধরা হয়।
ইমরান খানের উত্থানের জন্য এস্টাবলিশমেন্টের ভ‚মিকাকে প্রতিপক্ষ দায়ী করে। আর সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুতির পর ইমরান খানের দলের বিভিন্ন নেতা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে তাদের ক্ষমতাচ্যুতিতে কলকাঠি নাড়ার জন্য এস্টাবলিশমেন্টকে দায়ী করেছেন। যদিও ইমরান খান প্রকাশ্যে জনসভায় বলেছেন, তার চেয়েও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেনাবাহিনীর শক্তিমান থাকা অনেক বেশি প্রয়োজন। কিন্তু ইমরানের চিফ অব স্টাফ পারভেজ গিলকে গ্রেফতার করা হয়েছে মূলত সেনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে। এই মামলার সাথে ইমরান খানকে জড়ানোর জল্পনা রয়েছে ব্যাপকভাবে। এর মধ্যে পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার অজুহাত তৈরির মতো একটি অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। কমিশন অভিযোগ করছে বিধিভঙ্গ করে পিটিআই বিদেশী সহায়তা নিয়েছে।
পারভেজ মোশাররফের বিদায়ের পর পাকিস্তানের সেনা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ (পড়ুন অভ্যুত্থান) করতে দেখা যায়নি। যদিও ক্ষমতার পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। তা সত্তে¡ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্রমাগতভাবেই সামরিক প্রতিষ্ঠান বিরোধী হয়ে উঠছে। বেলুচিস্তান ও খায়বার পাখতুন খোয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রবাদী তৎপরতায় সামরিক বাহিনীর পেছনে রাজনৈতিক শক্তির জোরালো অবস্থান ছিল অতীতে। এখনো পর্যন্ত দেশটির অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী দেশটির অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু দল মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক শক্তির সাথে সামরিক প্রতিষ্ঠানের যেভাবে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে তাতে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের অবস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
অথচ জাতীয় সঙ্কটকালে অনেক সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ত্রাতার ভ‚মিকাটি অস্বীকার করা হয় না। এমনকি পাকিস্তানে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ ছাড়া অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা কঠিন ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
সরকারের পরিবর্তনের আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোতে ক্ষত বেশ গভীর হয়ে উঠে। আমেরিকার নানা ধরনের বিধি নিষেধের মধ্যে পড়ে দেশটির আমদানি ব্যয় রফতানির দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২ বিলিয়ন ডলারের কোটায় নেমে আসে। পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি ঘটতে শুরু করে তাতে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক তথা পশ্চিমের সাথে সমঝোতায় না এলে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ত বলে সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট মনে করে। এ অবস্থায় ইমরানকে হটিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে কিছুটা সময় নিয়ে নির্বাচন দেয়া হলে সঙ্কট এতটা হয়তো ঘনীভূত হতো না। কিন্তু সেটি না করে পরাজিত দলগুলোর কোয়ালিশনকে ক্ষমতায় এনে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটানো হয়েছে।
ইমরান খান তার বছর তিনেক সরকার পরিচালনার সময় অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করা এবং দুর্নীতির মূল্যোৎপাটনের প্রচেষ্টা নিয়েছেন। কিন্তু ঘন ঘন অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন এবং পরিণামদর্শী নীতি গ্রহণে ব্যর্থতার ফলে পরিস্থিতির অবনতি তিনি ঠেকাতে পারেননি। আর ইমরান খান আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং আরো কিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সাথে দূরত্ব তৈরি করেন। এর ফলে পাকিস্তানের চীন-আমেরিকার সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য তার শাসনের শেষ দিকে রক্ষিত হয়নি। আর চীনের দেয়া ঋণ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সহায়তা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কার্যকর প্রমাণ হয়নি।
এই অবস্থার সাথে রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যুক্ত হবার কারণে দেশটির অর্থনীতির দ্রুত অবনয়ন ঘটতে থাকে। অনিবার্য হয়ে ওঠে ডিপ স্টেটের হস্তক্ষেপ। কিন্তু যেভাবে এই হস্তক্ষেপ হয়েছে সেটিকে দেশটির জনগণ সম্ভবত ভালোভাবে নেয়নি। ফলে ইমরান খান তার তিন বছরের অসফল শাসনের পরও জনমত নিজের পক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার মেয়াদের মাঝামাঝি এসে ১০ এপ্রিল পদ থেকে অপসারিত হন। ইমরান খানকে ২০১৮ সালে একটি কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল বলে প্রতিপক্ষ দলগুলো বিশ্বাস করে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাকিস্তান মুসলিম লীগের শাসনে জনগণ ও এস্টাবলিশন্টের বিরক্তি এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। নতুন শাসনের লক্ষ্য ছিল আগের দশ বছরের পুনরাবৃত্তি এড়ানো। বাস্তবেও, দেশ শাসন ও রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়নের সেনাবাহিনী এবং ইমরান খানের বোঝাপড়া ঠিকঠাক ছিল। তবে খান এবং সামরিক সংস্থার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে কে পরবর্তী সেনাপ্রধান হবেন তা নিয়ে মতবিরোধে। ইমরান খান চেয়েছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকে পরবর্তী সেনাপ্রধান করতে। কিন্তু বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া, সম্ভবত নিজেকে বহাল রাখা অথবা অনুগত কাউকে এই পদে কামনা করেছেন। এ নিয়ে অচলাবস্থার পরিণতি ঘটে সামরিক নেতৃত্বের বিজয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরানের পদচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ইমরানের অপসারণের পরপরই, জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অনুসারী জনসাধারণকে তিনি রাস্তায় নিয়ে আসেন। তারপর থেকে, সামরিক বাহিনী চাপের মুখে পড়ে, রাজনৈতিক প্রকৌশলের জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়। প্রকৃতপক্ষে, ইমরান খানের সাথে সেনাবাহিনীর বিরোধের ফলে তার জাস্টিস পার্টির (পিটিআই) অনেক ‘কর্মী’ বিশেষভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনা নেতৃত্বের সমালোচনা শুরু করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব আরো বেড়ে যায়।
ইমরান খান, ১৭ জুলাই পাঞ্জাবের উপনির্বাচনে তার দলকে একটি বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যান। এটি এই ইঙ্গিত দেয় যে তিনি শান্তভাবে সমর্পণে যাবেন না। পিটিআইয়ের সাফল্যের সহজতম ব্যাখ্যা ছিল শক্তিশালী ক্ষমতাবিরোধী মনোভাব। ২০ শতাংশের উপরে মূল্যস্ফীতিসহ, জনগণ ক্ষমতায় থাকা দলগুলোকে ম্যান্ডেট দিয়ে পুরস্কৃত করতে ঘৃণা করে। প্রকৃত পক্ষে, ইমরান খানের পিটিআই থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের পিএমএল-এন জোট সরকারে রূপান্তর যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং না হলেও, পাকিস্তান এখন সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। এর একটি বড় কারণ হিসাবে, বিপুল বিদেশী ঋণের বিষয়টি সামনে আনা হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে পাকিস্তানের আমদানি বিল বেড়ে গেছে। এর পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায়ও সঙ্কট আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানি মুদ্রা মূল্য হারিয়েছে ৩০ শতাংশ। ফলে সব আমদানিপণ্য হঠাৎ করে অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ।
অনেক অর্থনীতিবিদ উদ্বিগ্ন যে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসাবে খেলাপি হয়ে যেতে পারে। এমন একটি ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে কিনা তা আইএমএফ-এর সহায়তার মাত্রা এবং গতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। এর পাশাপাশি সৌদি আরব বা চীনের মতো দেশগুলো ঋণ মওকুফ, পুনর্গঠন বা সাধারণ নগদ আকারে কতটা ইসলামাবাদকে সহায়তা দিতে ইচ্ছুক তাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেরা পরিস্থিতিতেও আইএমএফ, সৌদি বা চীনা অর্থের ‘সমাধান’ হয়তো সাময়িক স্বস্তি আনতে পারে। তবে ঋণ সমস্যা এতে দূর হচ্ছে না। দেশটির উচ্চবিত্ত, সেই সাথে উদ্যোক্তা মধ্যবিত্তরা কর দেয় না। পূর্ববর্তী সরকারগুলো দেশের ভোগবাদী অর্থনীতি চালু রাখতে কৃত্রিমভাবে বিনিময় হার স্ফীত করা বা জ্বালানির দাম কমিয়ে রাখার মতো জনতুষ্টিবাদী নীতি গ্রহণ করে। এতে বকেয়া বিদেশি দায় আরো বেড়েছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট পরষ্পর সংযুক্ত। যদিও রাজনৈতিক উত্থান এবং শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সরাসরি অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেনি, তবে এগুলো অবশ্যই অস্থিরতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বিনিয়োগকারী এবং ঋণদাতাদের সামনে এমন দৃশ্যপট হাজির হয়েছে যে পাকিস্তানের রাজনীতি বর্তমানে অবাধ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যায়ে রয়েছে। এমন এক সঙ্কটকালে যখন দেশের সবার সহযোগিতা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন তখন, রাজনৈতিক অভিজাতরা সঙ্কীর্ণ ক্ষমতার খেলায় আটকা পড়েছে। সবচেয়ে বড় প্রদেশ পাঞ্জাবে কোন দল ক্ষমতায় আছে বা যাবে তা নিয়ে চলমান রাজনৈতিক-বিচারিক লড়াই এবং কখন, সঠিকভাবে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে বিরোধ-সঙ্ঘাত এখন চরমে। এই অবস্থাটি কোন পরিবর্তন নিয়ে আসবে কিনা এই প্রশ্নে মূলত দু’টি মতামত রয়েছে।
প্রথম মত অনুসারে, জনগণ শিগগিরই এস্টাবলিশমেন্টের ভূমিকাকে ক্ষমা করবে এবং বিপত্তি ভুলে যাবে। সর্বোপরি, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জনসাধারণের চোখে এই প্রথমবার হোঁচট খেয়েছে। সমসাময়িক সময়ে, সামরিক বাহিনীকে ব্যাপকভাবে উপহাস করা হয়েছিল মার্কিন বাহিনীর হাতে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পরের দিনগুলোতে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস পরে, সেনাবাহিনী এবং তার তৎকালীন প্রধান, রাহিল শরিফ, প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি তীব্র জনসংযোগ অভিযান চালান। কিছু দিন পর, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। এবারের সঙ্কটেও তেমন কিছু হতে পারে।
দ্বিতীয় মত অনুসারে, ঐতিহাসিকভাবে, শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর বহিঃপ্রকাশের ভূমিকায় উল্লাস প্রকাশ করে। কিন্তু এই শ্রেণীগুলোই এখন প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছে। তাদের জন্য, সামরিক বাহিনীর ভুট্টো রাজবংশ ও শরিফদের আকারে ছোট করা এক জিনিস, কিন্তু তাদের প্রিয় নেতাকে টার্গেট করা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এই সমর্থকরা কখনো ভাবেননি যে চিতাবাঘ তাদের মুখ খেয়ে ফেলবে। ইমরান খান এমন আচরণের শিকার হতে পারেন এটি তারা ভাবেননি। প্রথমবারের মতো, সেনাবাহিনী এখন তাদের নিজ সমর্থক বলয়ে আক্রমণ করছে। এমনকি সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যরা, যাদের মধ্যে অনেকেই ইমরান খানের বড় ভক্ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় কঠোর সুরে সেনা নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন।
গত চল্লিশ বছরে সামরিক বাহিনীর স্থান ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ অভ্যুত্থান এখন অনেক পাকিস্তানির কাছে অকল্পনীয়। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকার বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনমত তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল প্রতিষ্ঠান, সামরিক বাহিনীর ক্রমাগত আধিপত্য ও ‘স্বাভাবিক’ রাজনীতির বাইরে চলে যাওয়া, সহিংস উগ্রবাদ, রাস্তার রাজনীতি, নতুন মিডিয়ার সংমিশ্রণ ইত্যাদি দেশকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে। নিরাপত্তা ফ্রন্টে, উগ্রপন্থী ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাস ও বিদ্রোহ এবং নয়া দিল্লির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গিতে পাকিস্তান গভীর ও গুরুতর বিপদের মুখে।
এখন মূলত পাকিস্তান এমন একটি দেশে পরিণত যেটি অনেক নাগরিকদের পানীয় জল এবং বিদ্যুতের মতো মৌলিক পরিষেবা দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। মাথাপিছু ভিত্তিতে এই অঞ্চলের এক সময়ের সবচেয়ে ধনী দেশ থেকে পাকিস্তান এখন ভারত ও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। এর পরও পাকিস্তানের বাস্তবতা হলো এটি একমাত্র পরমাণু শক্তিধর মুসলিম দেশ। প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার মতো অন্তর্নিহিত শক্তি দেশটির মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে।
আর যে দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ২৫ বছরের কম বয়সী সে দেশের সামনে সম্ভাবনাও বিপুল। রাষ্ট্রকে সঠিক নীতি ও পরিণামদর্শী পথে এগিয়ে নিতে পারলে দেশটির অপরিমেয় ভবিষ্যৎ রয়েছে। তবে এ জন্য পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আরো দায়িত্ববান হতে হবে। সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা এমন একটি পর্যায়ে সীমিত থাকার প্রয়োজন রয়েছে যাতে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারে মানুষের শেষ ভরসাস্থল হিসাবে সেনা প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে পারে। তা না হলে যারা দেশটিকে আবারো বিখণ্ড করার স্বপ্ন দেখে তাদের প্রয়াশই সামনে এগুতে থাকবে।
mrkmmb@gmail.com