আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়েছে’। (সূরা মুমিনুন-০১)
আপনি একজন মুমিন, একজন ঈমানদার, একজন আল্লাহপ্রেমী মানুষ, কখনোই হতাশ হতে পারে না। হতাশা মুমিনের সাথে যায় না। সবসময় আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে, তাঁর করুণা, দয়া ও স্নেহের যে আলোকধারা মুমিনের ওপর বর্ষিত হচ্ছে, তা থেকে আপনি (মুমিন) কীভাবে নিরাশ হবেন? ইহকালীন ব্যর্থতা, পরাজয়ে আপনার কী আসে যায়, বলুন? আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তারা হতাশ হয় না। দুনিয়ার অপূর্ণতা তাদের আঘাত দেয় না। বরং তারা প্রতীক্ষার প্রহর গুনে মহা সফলতার। সেই সফলতা, যার ওয়াদা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। আপনার আত্মা যখন আল্লাহর ভরসায় পরিপূর্ণ তখন সিজদায় গিয়ে বলুন, হে আল্লাহ! আমি আমার নিজের ওপর জুলুম করেছি আমাকে তোমার রহমত থেকে নিরাশ করো না। ‘(হে নবী,) বলে দাও, হে আমার বান্দারা, যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা আয-যুমার-৫৩)
আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টি এ মহাবিশ্বকে বানিয়েছেন একটি বিশাল পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে, আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং (তোমাদের) জানমাল ও ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।’ (সূরা বাকারা-১৫৫) মুমিনদের জন্য পরীক্ষা আসবেই যে পরীক্ষা থেকে বাদ পড়েননি কোনো নবী ও রাসূল। আমরা যদি শিশু নবী মুসা আ:-এর জীবনী দেখি জন্মের পর তার মাকে নির্দেশ করা হলো তাকে যেন একটি বাক্সে ভরে ভাসিয়ে দেয়া হয়, পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘আর আমি মুসার মায়ের কাছে এই মর্মে নির্দেশ পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাও। এরপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে।’ (সূরা কাসাস-০৭) একদিকে ফিরাউন বাহিনী অন্যদিকে সন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া- এ যেন স্থলের সিংহের ভয়ে জলের কুমিরের মুখে সন্তানকে ঠেলে দেয়ার মতো কিছু। আমার-আপনার মনে যে ভয় তা কি মুসা আ:-এর মায়ের মনে উদয় হয়নি? হয়েছে, তবে তাকে হতাশা কিংবা ভয় গ্রাস করতে পারেনি। তিনি যখন আল্লাহ তায়ালার ওপর পরিপূর্ণ ভরসা করেছেন, তখন আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করলেন, ‘আর একদম ভয় করবে না এবং চিন্তাও করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমার সন্তানকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করব।’ (সূরা কাসাস-০৭)
আবার আমরা যদি মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর দিকে তাকাই তার তিন তিনটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল কিন্তু কেউ এ ধরণীর বুকে ছিল না, সবাইকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিয়ে গেছেন। কই তিনি তো হতাশ হননি। যে মক্কাবাসী তাকে আল-আমিন উপাধি দিয়েছিল তারাই তো তাকে শিয়াবে আবু তালিবে বন্দী রেখেছিল তিনটি বছর। তাদের জুলুম নির্যাতন এতটাই তীব্র ছিল যে, শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে আল্লাহর হুকুমে জন্মভূমি থেকে হিজরত করতে হয়েছিল, তারপরও তো তিনি হতাশ হননি। আমরা যদি মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর দিকে তাকাই আমরা দেখতে পাই, তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে এক সৎ ছেলে সন্তান দান করুন’। (সূরা সাফফাত-১০০) তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে সুসংবাদ দিলেন, ‘সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম’। (সূরা সাফফাত-১০১)
যার নাম হজরত ইসমাইল আ: প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র সন্তান যখন তার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন তাকে কোরবানি করার নির্দেশ করা হলো, তিনি হতাশ হননি, বরং তিনি রবের ওপর ভরসা করে পুত্র ইসমাইলকে স্বপ্নের কথা বললেন, তখন ইসমাইল আ: বললেন, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা পালন করুন আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে সহনশীল পাবেন, ‘অতপর যখন সে পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি? সে (ইসমাইল) বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে সবরকারী (সহনশীল) পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২)
পিতা-পুত্রের কেউ তো হতাশ হননি; বরং তারা রবের ওপর ভরসা করে আল্লাহ তায়ালাকে রাজি খুশি করার জন্য পুত্র ইসমাইলকে জবাই করার জন্য শায়িত করেন, তখন আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটি এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ (সূরা সাফফাত : ১০৫-১০৬)
হজরত জাকারিয়া আ:-এর ঘটনা আমাদের সবারই জানা আছে। তিনি মারইয়াম আ:-এর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি যখনই মারইয়ামের কক্ষে প্রবেশ করতেন তখনই তাঁর কাছে বে-মৌসুমের বিরল খাদ্যদ্রব্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, হে মারইয়াম, এসব তুমি কোথায় পেলে? তিনি বলতেন, ‘এসব আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান করেন।’ (সূরা আলে ইমরান-৩৭)
তখন পর্যন্ত জাকারিয়া আ:-এর কোনো সন্তান ছিল না, তিনি মনে মনে ভাবলেন আর বললেন, যে আল্লাহ বে-মৌসুমে ফল দিতে পারেন, সে আল্লাহ বৃদ্ধ বয়সে আমাকে সন্তানও দিতে পারেন। তখন তিনি হতাশ না হয়ে দোয়া করলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার কাছ থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (সূরা আলে ইমরান-৩৮) আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ওপর ভরসা করে তাঁর (আল্লাহ) কাছে চাইলে তিনি কাউকে কখনো হতাশ করেন না। এমনকি ইবলিশ শয়তানকে যখন আল্লাহ তায়ালা চিরস্থায়ী জাহান্নামি হিসেবে ঘোষণা করলেন তখন ইবলিশও হতাশ হয়নি, সে আল্লাহ তায়ালার ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে আল্লাহ তায়ালার কাছে চেয়েছিল- তাকে যেন কিয়ামত পর্যন্ত হায়াত দেয়া হয়। ‘আমাকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দাও যখন এদের সবাইকে পুনর্বার ওঠানো হবে, তিনি বললেন, ‘তোকে অবকাশ দেয়া হলো’। (সূরা আল-আরাফ : ১৪-১৫) মানুষের শিরায় শিরায় যাওয়ার ক্ষমতা চাইল। আল্লাহ তাকে তাও দিলেন। মহানবী সা: বলেন, ‘অবশ্যই শয়তান আদম সন্তানের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে’। (সহিহ বুখারি-১২৮৮)
সর্বশেষ বলা যায়, দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার। (সহিহ মুসলিম-২৯৫৬ ) সুতরাং কারাগার তো শান্তি কিংবা আরাম আয়েশের জায়গা নয়। এটি দুঃখ কষ্ট বেদনা যন্ত্রণার জায়গা। থাকা খাওয়ার কষ্ট, ভালো না লাগা প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা, নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করতে না পারার অসীম বেদনা, মনের গহিনে লুকায়িত সুপ্ত যন্ত্রণা যা হয়তো বা এ পৃথিবীর কেউ জানে না।
অতএব যারা মুমিন, আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দা তাদের জন্য তো দুনিয়া কারাগার। আর কারাগার মানেই তো দুঃখ আর কষ্টের জায়গা। মুমিনের জন্য দুনিয়াতে দুঃখ কষ্ট থাকবে- এটাই স্বাভাবিক তবুও মুমিন কখনো হতাশ হবে না। মুমিন এই সমস্যাগুলোকে সাথে নিয়েই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ওপর ভরসা করে হতাশ না হয়ে আমৃত্যু জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, আর এটিই হলো একজন প্রকৃত মুমিনের বেশিষ্ট্য।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়