দেশের অর্থনীতিতে এখন সংকট চলছে। দিন যত যাচ্ছে, সংকট ততো ঘনীভ‚ত হচ্ছে। এই সংকট সাধারণ মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে দুর্ভোগ। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ওদিকে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা দূরে থাক, পুরোনোগুলোই টিকে থাকতে পারছে না। ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরাই ভালো আছেন শুধু, বাকিদের অবস্থা খারাপ। দেশের এ অবস্থার জন্য দায়ী কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, মোটা দাগে তিন কারণে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতির এ সংকট। প্রথমটি হলো, দীর্ঘদিন থেকে রাষ্ট্রীয় খাতগুলোর সংস্কার হয়নি। দ্বিতীয় কারণ, করোনার অভিঘাতে অর্থনীতির চাকা ঠিকমতো ঘুরতে পারেনি, অধিকন্তু জনজীবন হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। তৃতীয়ত, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলসহ দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ তো গেল মোটা দাগের তিন কারণ। ওদিকে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে চার ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে। এগুলো হলো-ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ না হওয়া, কর আহরণে দুর্বলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য। তার মতে, আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাই অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। অর্থনীতিবিদদের মতে, তিন ধরনের সংকটে পড়তে পারে দেশ। প্রথমত, খাদ্য আমদানি ব্যাপকহারে বাড়াতে হতে পারে, যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় মন্দায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এর প্রভাবে রপ্তানি অর্ডার বাতিল হচ্ছে। ফলে কমে যেতে পারে রপ্তানি আয়। তৃতীয়ত, এলসি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে বাড়ছে বকেয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধও। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ও বিনিময় হারে সংকট আরও ঘনীভ‚ত হতে পারে। সবটা মিলে আগামীতে দেশ পড়তে পারে বড় ধরনের চাপে।
দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় সরকারকে অবশ্যই সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। অর্থনীতিবিদরা জরুরি ভিত্তিতে চারটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন। প্রথমত, ব্যাংকিং চ্যানেলে বা এলসির মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে এটি শুরু হয়েছে, তবে তা আরও জোরদার করতে হব। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমাতে হবে ও তা সহজ করতে হবে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। চতুর্থত, কৃষিতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেশের ভেতরে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমরাও মনে করি, এসব পদক্ষেপ সংকট উত্তরণে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করতে পারে। আমরা এই পরামর্শগুলো আমলে নিতে সরকারের প্রতি আহŸান জানাই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকার যদিও বলছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে খাদ্য উৎপাদন বেশি হয়েছে; কিন্তু কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন-প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর খাদ্যের চাহিদা বাড়বে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দামও বেশি। সবদিক বিবেচনায় নিলে আগামীতে খাদ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। পরের কথা হচ্ছে, আমদানি ব্যয় বাড়বে একদিকে, অন্যদিকে কমবে রপ্তানি আয়। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৩৪ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে এ খাতে আয় ১২ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু অর্থবছরের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। সরকারকে এই বাস্তবতা আমলে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।