বুলবুল ভাইকে নিয়ে কিছু বলা আমার জন্য যেমন সহজ তেমনি কঠিনও বটে। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন অথবা বলা যায় প্রায় পুরোটা সময়ই আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। শ্রদ্ধেয় কণ্ঠজাদুকর সাবিনা ইয়াসমিন আপার পরে আমিই সর্বোচ্চ তার ভালো ভালো গান গেয়েছি। সেই সুবাদে আমি তাকে অনেক কাছে থেকে দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি।
তিনি ছিলেন একজন স্বভাবকবি। বলা যায় মুখে মুখে তিনি গান রচনা করতেন, গান রেকর্ড হলে তা সংরক্ষণ করতেন না এবং ভুলে যেতেন। তিনি বলতেন আমার গান মনে রাখার দায় আমার নয়, সংরক্ষণ করারও দায়িত্ব আমার নয়। গান ভালো হলে কালের পরিক্রমায় তা এমনিতেই থেকে যাবে। এমন হেলাফেলা একজন রাজাই করতে পারেন!
যে কোনো শিল্পীকে দিয়েই তিনি সেই শিল্পীর পারঙ্গম ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। গানের এত বিষয়বস্তু নিয়ে খুব কম সুরকারই কাজ করেছেন। এবং তার জীবদ্দশায় তিনি নিরলসভাবে শেকলের মতো একটার পর একটা গান গেঁথে গেঁথে নিয়মিত কাজ করেছেন। বলা যায় তার সর্দি লাগলে গানের পুরো জগতের জ্বর এসে যেত। তার জীবনে সুর করা একটা গানও মাটিতে পড়েনি।
যেহেতু তিনি একই সঙ্গে লিখতেন এবং সুর করতেন তাই তার গানে সুরের মায়া বেশি থাকত এটা বলাই বাহুল্য। কারণ একটি গানের তিনিই ছিলেন মা এবং বাবার মতো। ব্যক্তিজীবনে অনেকটা খামখেয়ালি দেখা গেলেও আসলে এই জাতশিল্পী ছিলেন তার গানের প্রতি খুব যত্নবান।
বাসায় তিনি নিয়মিত গিটার নিয়ে গান সাধনায় রত থাকতেন। মনের সুখে ভালোবেসে নিয়মিত কিবোর্ড নিয়ে খেলতেন। প্রথম জীবনে তিনি ভায়োলিন বাজাতেন এবং শেষের দিকে তিনি সেই ভায়োলিনকে আবার জাগিয়ে তুলেছিলেন। ভায়োলিনে নিজের জনপ্রিয় গানগুলো আবারও বাজিয়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। এ যেন নিজের কাছেই নিজের দায় মেটানোর মতো। কিবোর্ডে তিনি তার গানগুলো আবারও নতুন করে বাজিয়ে রেকর্ড করেছিলেন এবং তা ছিল একটি বিস্ময়কর অধ্যায়। গানের নোটেশন নিয়েও বই লিখেছিলেন। বইটি আমার এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি ফোনে সেই বইয়ের কিছু লেখা আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে কাপড় জামা চুলের স্টাইল নিয়েও তার ব্যাপক সচেতনতা ছিল। একসময় হয়তো শুধুই কালো পাঞ্জাবি-পাজামা পরতেন। আবার কিছুদিন দেখা গেল সেই কালো সাদায় পরিণত হয়ে গেছে, কতদিন দেখলাম উনি সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে সাদা লুঙ্গি পরে স্টুডিওতে আসা শুরু করলেন। কিছুদিন উনি খুব দামি আতর সঙ্গে নিয়ে বেড়াতেন আর সবার হাতে তা লাগিয়ে দিতেন। খাবার নিয়ে তার অবসেশন থাকলেও খেতেন খুব কম।
আমার গান নিয়ে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন, তাই দীর্ঘ সময় আমি তার আস্থাভাজন শিল্পী ছিলাম। সেজন্য আমার যুগে ওনার ছবির গানে নারীকণ্ঠের সব গানই আমাকে দিয়ে গাইয়েছেন। আমার কণ্ঠ নিয়ে তিনিই নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করা শুরু করেছিলেন। সবাই ভাবত কনকচাঁপার কণ্ঠে শুধুই মেলোডি স্যাড রোমান্টিক গান মানায়। কিন্তু তিনি আমাকে দিয়ে নানান রসের গান যেমন ব্যঙ্গাত্মক, পল্লীগীতি, বাচ্চাদের গান, যুদ্ধংদেহী, সেক্সি, রক স্টাইলের, মাতালের গানও গাইয়েছেন। আমি সেগুলো গানের মাধ্যমে নিজেকে নিজে পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছি। জীবনের পয়লা যখন পাঁড় মাতালের গান গাইলাম ওনার সুরে ‘খাওয়াইলা কি মালটা লাগে উল্টাপাল্টা’,
আমি নিজেই তাজ্জব হয়ে গেলাম যে এই গানও আমি গাইতে পারলাম? এর পর আমি এমন মাতালের গান অনেক গেয়েছি। কত মানুষ ভবের বাজারে গানটি আমাকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য প্রডিউসারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। কারণ প্রডিউসার বলেছিলেন এ গান ফোক শিল্পীর। উনি আমাকে সেই চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে চালাকি করে আমার জিদ বাড়িয়ে দিয়ে ঠিকই গাইয়ে নিয়েছিলেন। একটা সময় উনি আমার ওপর একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে আমার কণ্ঠ এফ শার্পের ওপরে যাচ্ছিল না। উনি সেটা এমনভাবে বললেন যে আমি আবার সেটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে জিদ করে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। আমার জীবনে আমি তার অবদান কখনো ভুলতে পারব না।
তবে একটা কথা কী, একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাই যদি ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানটি ছাড়া আর একটি গানও জন্ম না দিতেন, তা হলেও বাংলা জাতি তার কাছে এক সমান ঋণী থেকে যেত!
তার অনুপস্থিতি সারা বাংলাদেশকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। কারণ হাজার বছরেও আর একবারও এমন মহান শিল্পী জন্মাবে না। এই মহা শিল্পী, সুরের কথার জাদুকর, এই স্বভাবকবি, এই সুরের সাধক আমাদের মাঝে নেই এটা আমি কখনো ভাবি না। এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাংলার মাটি আকাশ বাতাস নদীর ধারায় জলপ্রপাতের মতো শক্তি নিয়ে জেগে আছেন, থাকবেন। তার জন্য আমার দোয়া, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আজীবনের। যেখানেই থাকেন, ভালো থাকেন সুরের মহাজাদুকর।