চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগেও প্রতি গ্রামের সম্পন্ন বাড়িগুলোর পেছনে দেখা যেত ছোট বন অর্থাৎ জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা। সেই জায়গায় তাল, তেঁতুল, অরবড়ই, বেল, জাম, লটকন ইত্যাদি গাছ থাকত। ঘন জঙ্গলে বেড়ে উঠত এমনিতেই নানা গাছ। হয়তো পাখির খাবার থেকে বা ছুড়ে ফেলা বর্জ্য থেকে। এভাবেই আস্তে আস্তে সেগুলো বেড়ে উঠত। দরকারি-অদরকারি নানা বুনো ফল-ফুল, লতা-পাতার মধ্যে বেত, ঔষধি গাছ বেড়ে উঠতো অযত্নে। এসব জায়গায় ছোটখাটো বন্যপ্রাণীদের অভয়াশ্রম ছিল। ছিল নানা জাতের পাখির আবাস। সন্ধ্যা হতেই পাখির কিচির মিচির কাকলী যেমন গ্রামীণ প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করতো তেমনি ভোর ও তাদের কাকলীতে মুখর হতো মনোহর রূপে।
সম্ভবত বাড়ির পেছনের বনের রূপটি এখন আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ গাছ-জঙ্গল কেটে জমি সাফ করে ফসল করা হয়, না হয়তো ঘরবাড়ি সম্প্রসারিত করার কাজ হয়েছে।
সম্পন্ন মানুষদের আরেকটি সংস্কৃতি ছিল যার যার নিজস্ব পুকুর অথবা বাড়ির কয়েক শরিকের একসাথে এক এজমালি পুকুর। পুকুর করার অর্থ প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এবং মাছ চাষ। এখন অনেক পুকুরেরই অস্তিত্ব নেই। হেজে মজে আগাছায় পূর্ণ হয়েছে অনেক পুকুর, অনেক পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িসংলগ্ন পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে হয়তো প্রয়োজনেই। কারণ পূর্বযুগের মানুষের ধ্যানধারণা আর বর্তমান যুগের মানুষের ধ্যানধারণার তফাত। আর শরিকানা মালিকের পুকুরের তো শরিকও বেড়ে গেছে। ফলে কে আর এর চাপ নেয়। কেউবা সংস্কার করে। তাই পুকুর বুজে যায় অথবা ভরাট ফেলা হয়। পূর্বপুরুষদের স্মৃতি নিয়ে বসে থাকার মন-মানসিকতা আধুনিক মানুষের নেই।
পূর্বপুরুষরা সুবিবেচক ছিলেন। পুকুরে মাছ চাষ, সন্তানাদির সাঁতার শেখা, আপৎকালীন সময়ে পানির চাহিদা পূরণ, সর্বোপরি বাড়ির আবহাওয়া শীতল রাখার বিষয়টি তাদের মাথায় ছিল। এখনকার মানুষ অনেক কিছুই শিখেছে, হারিয়েছে বিবেচনাবোধ। পুকুর ফেলনা হয়ে গেছে। আগে ঘরবাড়িতে আগুন লাগলে পুকুর থেকেই পানি নিয়ে সেচন করা হতো, খরাকালে পুকুরের পানি ছিল সেচের উৎস।
সাম্প্রতিককালেও শুধু শহরে কেন, গ্রামগঞ্জের হাটবাজার বা আবাসস্থলে, কারখানায় আগুন লাগলে পুকুরের খোঁজ পড়ে। দমকল বাহিনীর পানির প্রয়োজন হলে পানির উৎস ‘পুকুর’ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে ক্ষতি হয় বেশুমার, পুড়ে ছাই হয় দোকানপাট, আস্তানা।
পুকুরপাড়ে নারকেল, সুপারি, তালগাছ লাগিয়ে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ ভোগ করা গ্রামবাসীর আর হয় না। সম্পন্ন গৃহস্থদের বাড়ির কাছে অথবা অনতিদূরে আম-কাঁঠালের বাগান থাকত। বাণিজ্যিকভাবে আম কাঁঠাল হয়তো এখনো এলাকাভেদে চাষ হয় কিন্তু গৃহস্থদের আম কাঁঠাল বাগানের অস্তিত্ব নেই বোধ হয়। পুরনো গাছ কাটা হয়েছে কিন্তু নতুন বাগান কেউ করেনি- এমন উদাহরণ ভ‚রি ভ‚রি। এসব বাগান ছিল পাখির অভয়ারণ্য। টিয়া, শালিক, কাক, হরবোলা, চড়ই, বক, আরো নাম না জানা শত শত পাখির আবাসস্থল ছিল এসব বাগান।
পাখির নানা রঙের ডিমের খোসা দেখেই বুঝা যেতো কত পাখ-পাখালি নিরাপদ বাগানের আশ্রয়ে মনের সুখে বাসা বাঁধতো আর ডিম-ছানা ফোটাতো।
বর্তমানেও সৃজিত বনভূমি অথবা বাড়ির আশপাশে রাস্তার ধারে বা ক্ষেত জমিতে দ্রুত বর্ধনশীল গাছপালা দেখা যায় যা কাঠের গাছ নামে পরিচিত। দেশীয় গাছ ছেড়ে মানুষ কাঠের গাছ লাগাচ্ছে বা লাগিয়েছে যেগুলো বিদেশী প্রজাতির। এর মধ্যে আকাশী, রাবার, ইউক্যালিপ্টাস ইত্যাদি; মেহগনি, দেবদারু, শাল। মেহগনি ও শাল কাঠ দামি বলে এগুলো বাণিজ্যিক বাগান হিসাবেও গড়ে উঠেছে। জানা গেছে, দ্রুত বর্ধনশীল ও মুনাফার সহজ উপায় হিসেবে বিদেশী বৃক্ষের বনায়ন নিয়ে হিড়িক তুলে লাগানো হয়েছে এসব গাছ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সিলেট ও মৌলভীবাজারে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সামাজিক বনায়ন এবং ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচুর বিদেশী গাছ লাগানো হয়েছে। অথচ বিদেশী গাছের স্থলে দেশীয় প্রজাতির মূল্যবান কাঠ ও ফল-ফলাদি ও ঔষধি গাছে বনায়ন করা যেতো যা উপেক্ষা করা হয়েছে। জানা গেছে, প্রয়াত প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার মতে, ইউক্যালিপটাস, শিশু, মেহগনি, রেইনট্রি ইত্যাদি গাছগুলো মাটি থেকে প্রচুর পানি শোষণ করে জমি শুকিয়ে ফেলে। এসব গাছের শিকড়ের বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো গভীর মাটিতে প্রোথিত হয় না, শিকড় ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। ফলে মাটিতে অন্য গাছপালা বর্ধনের ক্ষমতা হারায়।
এ দেশের মাটিতে বনায়নের উপযুক্ত গাছ হলো যেগুলোর শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করে সেখান থেকেই পানি শোষণ করে। এই গাছগুলো লাগালে সংশ্লিষ্ট জায়গায় অন্যান্য গাছ জন্মাতে পারে, মাটি সজীব থাকে। অহেতুক কাণ্ডে বিভ্রান্ত হয়ে, পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করে যেসব গাছের বনায়ন করা হয়েছে বা বাড়ির আশপাশে, পুকুরধারে, ক্ষেতখামারের আলে চাষ করা হয়েছে, এর ফল ভোগ করছে মাটি ও প্রকৃতি। সড়কের শোভা বর্ধনের জন্যও বিদেশী গাছ বেছে নেয়া হয়েছে। এগুলোর ফুল অনেক সময় অ্যালার্জি ছড়ায় এবং প্রকৃতি পরিবেশের ক্ষতি তো করেই যাচ্ছে।
জানা গেছে, অ্যাকাশিয়া গাছ ঘন পল্লববিশিষ্ট যা দিয়ে সূর্যের কিরণ প্রবেশ করে না ফলে এর নিচে বা আশপাশে কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর পাতা পড়ে কৃষিক্ষেত নষ্ট হয়। ইউক্যালিপ্টাস গাছ যদি ক্ষেতের আলে লাগানো হয় তাহলে এর পাতা ধানের পাতা মোড়ানো রোগ সৃষ্টি করে অর্থাৎ ছত্রাক রোগের আবির্ভাব হয়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই গাছগুলো আমাদের প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। বিদেশী গাছ মাটি জরাগ্রস্ত করছে, ফসল নষ্ট করছে, রোগবালাই ছড়াচ্ছে। কোন ভূখণ্ডে কোন গাছ পরিবেশের অনুকূল, সেটা আল্লাহ পাক ভালো জানেন এবং তিনি তাঁর সৃষ্টি সেইভাবে সাজিয়েছেন যাতে তার প্রকৃতি ও পরিবেশ সুচারু থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে অন্য দেশের ফল, বীজ, চারাগাছ নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ এবং এর ব্যতিক্রম ঘটলে অর্থাৎ কেউ কোনো জিনিসের ফাঁকে বা ব্যাগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে রীতিমতো তার আইনানুগ শাস্তি হয়। এমনকি চিরতরে ভিসাও বাতিল হয়। এটা তো এ জন্যই যায় যে, তারা নিজেদের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা রাখে।
অন্য দেশের একটি বীজ থেকে গাছ হওয়া মানে এর বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার। সেটা ঠেকাতে তারা বদ্ধপরিকর এবং দেশ ও পরিবেশ রক্ষায় তারা এক চিলতে ছাড় দিতেও নারাজ। অবশ্য তারা বীজ ও ফল আনতে দেয়। কারণ এটা তাদের বিষয় নয় যে, অন্যদেশে তাদের গাছগুলো কী ক্ষতি করবে সেটা দেখা।
আমাদের দেশে বিদেশী গাছ বা চারা যারা এনেছে তারা আমাদের প্রকৃতি পরিবেশের কথা ভাবেনি বা তারা দেশের কল্যাণ চায়নি। এত যে সামাজিক বা ব্যক্তিগত বনায়ন হয়েছে এগুলো অনুমোদন ছাড়া হয়নি। আমাদের দেশে প্রকৃতি বিজ্ঞানীও রয়েছেন। তারা খুব জোরেশোরে প্রচারণার জন্য হয়তো মিডিয়ার আনুকূল্যও পাননি। হয়তো দু’চারটি গ্রন্থ লিখেছেন। সেসবের খোঁজ কেউ রাখেনি অথবা মতামতের গুরুত্ব দেননি। ফলে গ্রামগঞ্জ দিয়ে চলতে গেলে রাস্তার দুইধারে আম, কাঁঠাল, হিজল, বট, তমাল, শিমুল, তাল, আমলকী, বহেড়া, হরীতকী, অর্জুন, বেল, বাবলা, ডুমুর, জলপাই, কড়ইগাছ দৃষ্টিগোচর হয় না, দৃষ্টিগোচরে আসে যা আমরা দেখিনি বা চিনি না সেসব গাছের সারি।
রাজধানী ঢাকার বিউটিফিকেশনেও বিদেশী গাছ দেখা যায়। কেন কোনো দেশীয় ফলদ গাছ লাগানো হয়নি আর যা লাগানো হয়েছে তার কোনো যত্ন নেই? কিছু কিছু দেবদারু দেখা যায়। দেবদারুগাছে পাখিও বসে না।
বিদেশী গাছে পাখি বসে না, বাসা করে না, ডিম ফোটায় না, বাচ্চা ফোটে না। বিদেশী গাছে দেশীয় পাখির খাদ্য নেই। এসব গাছ পাখিবান্ধব নয়। পাখি প্রকৃতিরই অংশ। বট-পাকুড়, নিম, তাল, আম, জাম, কাঁঠাল, বাঁশবন পাখিদের প্রিয়। অদেখা, অচেনা গাছ পাখিরাও বর্জন করেছে আর আমরা সেগুলো বুকে ঠাঁই দিয়েছি। কার বুদ্ধিতে, কাদের পরিকল্পনায় আমাদের প্রকৃতির সর্বনাশ হচ্ছে তা দেখার লোক নেই।