যারা বাস্তব জীবনে কঠিন সব যুদ্ধ পার করে এসেছেন তাদের হারানোর সাধ্য কার? বলছি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কথা। সমাজের টিপ্পনী, হাজারো বাধা-বিপত্তি, অভাব-অনটনের সংসার সবকিছু ছাপিয়ে এই মেয়েরা দেশের ফুটবলের সেরা সাফল্য এনে দিয়েছে। এই পর্যায়ে আসতে কাউকে তার পরিবার ছাড়তে হয়েছে, কেউ তার প্রিয় বাবাকে হারিয়েছে, কেউবা মাকে। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। অদম্য শক্তিতে এগিয়ে গেছে আর দেশের ফুটবলের সেরা সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে।
২০১০ সালে শুরু হওয়া সাফ ওমেন্স ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের সবচেয়ে সফল দল ভারত। টুর্নামেন্টের পাঁচ আসরের সবকটিতেই চ্যাম্পিয়ন তারা। তাই টুর্নামেন্টের যাত্রাটা মোটেও সহজ হবার কথা ছিল না বাংলাদেশের জন্য। একে তো ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য আর দ্বিতীয়ত খেলা নেপালের মাঠে। সেখানকার পরিবেশ, অতীত ইতিহাস সবকিছুই আমাদের বিপক্ষে। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর সাথে সাথে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে ঠিকই জ্বলে উঠলো বাংলার মেয়েরা। একে একে মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে ঠিকই পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।
সেখানে ভুটানকে ৮-০ গোলে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে যায় বাংলার মেয়েরা। গ্রুপ পর্ব আর নকআউট পর্বের ৪ ম্যাচ মিলিয়ে প্রতিপক্ষের জালে দেয় ২০ গোল। বিপরীতে একটা গোলও হজম করেনি। আর ফাইনালে ৩-১ গোলের জয় শেষে বাংলাদেশ টুর্নামেন্টে দিয়েছে মোট ২৩ গোল আর হজম করেছে মাত্র ১টি। সাথে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হবার তকমা তো আছেই।
ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেপাল। তাদের দেশ, তাদের হোম গ্রাউন্ড আর ১৫ হাজার সমর্থকের হুংকার। সবকিছু মিলিয়ে ফাইনালে ট্রফি ছিনিয়ে আনার কাজটা মোটেও সহজ হবে না আমাদের জন্য এটা সবাই জানতো। কিন্তু সানজিদার একটা পোস্টেই বোঝা যায় ট্রফিটা জয়ের জন্য কতটা মুখিয়ে আছে তিনিসহ পুরো দল। আর তাদের আত্মবিশ্বাসও আছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সবকিছু মিলিয়ে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশকে। নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ট্রফিটা নিজেদের করে নিয়েছে সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া, সানজিদা, শামসুন্নাহাররা।
এই জয়ের দাবিদার পুরো দল যারা কিনা লড়াই করে গেছে শেষ পর্যন্ত। যারা ইস্পাত কঠিন মনোবল দিয়ে জয় করেছে অধরা ট্রফিটি।
এই জয়ের দাবিদার গোলাম রাব্বানী ছোটন। যিনি তার যাদুতে বদলে দিয়েছেন দেশের নারী ফুটবলের চিত্রকে। যার ছোঁয়া আশা দেখছে আরো হাজারো তরুণী।
এই জয়ের দাবিদার কলসিন্দুর গ্রামের প্রতিটা পরিবার, স্কুলশিক্ষক আর কোচেরা। যাদের কারণে বাংলাদেশ দল সানজিদা, মারিয়া, শামসুন্নাহারদের পেয়েছে।
টুর্নামেন্টের ৫ আসরে ১ বার রানার্সআপ, ৩ বার সেমিফাইনাল, ১ বার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়। বারবার কাছে যেয়েও ছোঁয়া হয়নি ট্রফিটা। ছেলেদের ফুটবলেও নেই শান্তির আভাস। সেরা সাফল্য সেই ১৯ বছর আগের ২০০৩ সালের সাফের শিরোপা। সবকিছু মিলিয়ে একটা ট্রফি, একটা সাফল্যের জন্য দেশের ফুটবল যেনো হাহাকার করছিল। স্পনসর থেকে শুরু করে দেশের জনগণ সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল দেশের ফুটবল থেকে। ঠিক তখনই এমন সাফল্য যেন দেশের ফুটবলের জন্য সুবাতাস, দেশের মানুষের জন্য সেরা উপহার আর হাজারো ফুটবল পাগল তরুণ-তরুণীর জন্য অমূল্য অনুপ্রেরণা।
সানজিদা আপনি ঠিকই বলেছিলেন। যারা আপনাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এই জয় এক অমূল্য অর্জনের নাম। আপনাদের জন্য হয়তো ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসের আয়োজন করতে পারবো না আমরা কিন্তু দেশের ফুটবল, দেশের মানুষ, সমাজের টিপ্পনী কাটা নোংরা মানসিকতার মানুষসহ হাজারো তরুণ-তরুণীর কাছে আপনারা ঠিকই অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। এই সাফল্য ঠিকই আমাদের আপনাদের মতো নতুন সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে।
পাহাড়ের কাছে বাড়ি হওয়ায় জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াইটা খুব কাছ থেকে দেখেছেন আপনারা। দামি ঘর-বাড়ি, জামা-কাপড়, খেলার সরঞ্জাম কিছুই ছিল না আপনাদের। কিন্তু সেখানে থেকে লড়াই করে, জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে মাঠে ১১ জন যোদ্ধা যখন একসাথে দাঁড়িয়েছেন তখন আপনাদের হারানোর সাহস কারো নেই। আপনারা ঠিকই প্রমাণ করেছেন জীবনযুদ্ধের যোদ্ধারা খেলার মাঠেও সেরা। যারা জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছে তারা কখনোই হেরে যেতে পারে না।