সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মাঝামাঝি স্তরে যাদের অবস্থান তাদের মধ্যবিত্ত বলা হয়। তবে মধ্যবিত্তের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। বাংলা অভিধানে মধ্যবিত্ত শব্দ বলতে বোঝায়; ধনী-দরিদ্রের মধ্যবর্তী অবস্থাপন্ন গৃহস্থ; বিশেষ ধনী বা নিতান্ত দরিদ্র নয় এমন। মধ্যবিত্ত শব্দটি বড় নয়; কিন্তু অভিধানে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মধ্যবিত্তের জীবনটা কত যে কষ্টের তা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। মধ্যবিত্তের অবস্থা হচ্ছে ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। অর্থাৎ পণ্যের দাম বাড়লেই ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের অবস্থান রয়েছে। এই তিন শ্রেণীকে আমরা এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারিÑ ‘উচ্চবিত্ত শ্রেণী : তোমার নাম ভবনের গায়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী : তোমার নাম বুকে পুষে রাখা এক আকাশ আফসোসের ওপর। নিম্নবিত্ত শ্রেণী : তোমার নাম পোশাকে। মধ্যবিত্তরা সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ। তারাও রক্তে-বর্ণে মানুষ। তাদেরও সাধ-আহ্লাদ আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সাধ-আহ্লাদ কী জিনিস তা ভুলেই গেছে। দেশের উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভ‚মিকা কোনো অংশেই কম নয়। চীনের কথাই ধরা যাক। ১৯৭৮ সালের দিকে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হলেও চার দশকের মধ্যে চীন বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯১ সালে চীনে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ দরিদ্র ছিল। চীনে এখন সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। চীনের অগ্রযাত্রার পেছনেও মধ্যবিত্তের ভ‚মিকা অপরিসীম।
আমরা বড্ড কঠিন সময় অতিবাহিত করছি। রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাতে আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম রকেট গতিতে বাড়িয়ে দেয়া হয়। এতে বিপন্ন হয় মানুষের জীবন। কিন্তু জবাবদিহিতা না থাকায় ডিমের মতো পণ্যও লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন যারা সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কখনো চালের দাম, কখনো ডিম-মুরগির দাম, আবার কখনো কাঁচামরিচের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী স্র্রেফ নিজেদের পকেট ভারী করার স্বার্থে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন, ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কথা উঠলেই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কথা আসে। নিম্নবিত্ত টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড়াতে পারলেও মধ্যবিত্ত দৌড়াতে পারে না। মধ্যবিত্তরা পড়ে বিপাকে, পেটে খাবার না থাকলেও লজ্জায় কারো কাছে না পারে বলতে, না পারে খাবার জোগাড় করতে। তারা জীবনের সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, মাসিক বাজারের তালিকা ছোট করেও সংসারের খরচ মেটাতে পারছে না। একসময় নিম্নবিত্তরা সরকারি হাসপাতালের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিত। এখন মধ্যবিত্তরা দেড় মিনিটের সেবা নেয়ার জন্য সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। দ্রব্যমূল অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এরা না পারছে সইতে, না পারছে কাউকে কিছু বলতে। শুধু ভাগ্যকে দোষ দিয়ে একেকটি দিন পার করছে। নি¤œবিত্তের রেশন কার্ড, ফেয়ার প্রাইস কার্ড ও ভিজিএফ কার্ড আছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কোনো কার্ডই নেই। কারা পণ্যের দাম বাড়ায়? কারা সিন্ডিকেট তৈরি করে মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করছে! প্রশাসন কি তা জানে না? নিশ্চয় জানে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
মধ্যবিত্তের জীবনের গল্প লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। মধ্যবিত্তরা সর্বত্র নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। চাকরি বলুন আর ব্যবসায় বলুন; কোনো জায়গাতেই তাদের ঠাঁই হয় না। সব জায়গাতে তারা ঠকে। বেতন বাড়ে না। কিন্তু বাসাভাড়া বাড়ে। অফিসে বেতন বাড়ানোর কথা বললে পুঁজিবাদী স্টাইলে বলা হয়, না পোষালে চাকরি ছেড়ে চলে যান। অথচ বড় কর্তাব্যক্তিদের বছর ঘুরলেই বেতন বাড়ে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের বেতন কচ্ছপ গতিতেও বাড়ে না। এটি কি বৈষম্য নয়! বাড়িভাড়া বাড়লে চোখে সর্ষেফুল দেখে। কিন্তু কথা বলতে পারে না। বেশি কথা বললে বলেন, বাসা ছেড়ে চলে যান। অনেকে তো গরুর গোশত খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। যেখানে ডিম খাওয়ার মুরোদ নেই, সেখানে ৭০০ টাকা দিয়ে এক কেজি গোশত খাবেন কী করে? মাছের রাজা ইলিশ খেতে কার না ইচ্ছে করে বলুন? কিন্তু মধ্যবিত্ত ইলিশ কিনতে গিয়ে এক পা সামনে দিয়ে একটু উঁকি মেরে দু’পা পেছনে চলে আসে। কারণ একটিই- পকেটের বাজেটে ইলিশ কেনা সম্ভব নয়। একজন রিকশাওয়ালার আয়ের সমান আয় ধরে রাখতে পারে না একজন মধ্যবিত্ত। একজন রিকশাওয়ালা মাস শেষে বাড়িতে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারে। কিন্তু একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করলেও বাসাভাড়া আর মাসিক বাজার করতে গিয়ে মাস শেষে ঋণ করে সংসারের চাহিদা মেটাতে হয়। মাস শেষে রিকশাওয়ালার কিছু টাকা সঞ্চয় হয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের সঞ্চয় হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ঋণ করে জীবন বাঁচাতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের বোবাকান্না হাওয়ায় ভাসছে। কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম বাড়ছে। যে যার মতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে পকেট ভারী করছে। এতে সীমিত আয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীরা চাপে পড়েছেন। চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো বিপদ এলে তারা ব্যয় সঙ্কোচন নীতি অবলম্বন করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুধার্ত ও মজলুম মানুষের আহাজারি আল্লøাহতায়ালার আরশ নাড়ায়।
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে না, তখন সেখানে নানা অশান্তি দেখা দেয়। রাজনৈতিক সঙ্ঘাত সহিংসতা লেগেই থাকে। লুটপাট আর দুর্নীতির মহোৎসব দাপটের সাথে চলে। কিন্তু প্রতিকার মেলে না। দেশ যখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে, তখনো রাষ্ট্রের মধ্যবিত্তরা নিজেদের লালিত মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানের কারণে ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে। তারা না পারে অভাব-অনটন সইতে, না পারে গলা উঁচিয়ে জাহির করতে। কারণ তারা মানসম্মানের ফ্রেমে বন্দী। বিষয়টি এরকম, ‘করিতে পারি না কাজ/সদা ভয় সদা লাজ/পাছে লোকে কিছু বলে।’ বাজারে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। মধ্যবিত্তরা যা বেতন পান তার অর্ধেকই চলে যায় বাসাভাড়ায়। বাকি অর্ধেকে টেনেটুনে কোনোমতে মাসটা পার করেন; কিন্তু জীবনের বিপর্যয় ঠেকাতে পারেন না। মানুষের সাধারণত পেটে খেলে পিঠে সয়; কিন্তু পেটের খাবারেই যদি টান পড়ে, তখন আর হারানোর কোনো ভয় থাকে না। মধ্যবিত্তদের এই সামাজিক আওয়াজ যদি রাজপথে নেমে আসে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই কেবল মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্কট দূর করা সম্ভব।