সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:০৯ অপরাহ্ন

সীমান্ত উত্তেজনা আঞ্চলিক স্থিতির প্রতি হুমকি

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২
  • ১০৬ বার

১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা শুরু হয়। ২০১৭ সালে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হয়। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ফলে আগে থেকে অবস্থান করা শরণার্থীর সাথে এ বিপুলসংখ্যক যোগ হয়ে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। সে সময় মিয়ানমারের আধা সামরিক, আধা বেসামরিক সরকারের সৃষ্ট এই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং নির্যাতন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। শরণার্থী সমস্যা নিরসনে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা সব সময়ই নেতিবাচক। এখন সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরসার সাথে যে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তার বড় প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে। তারা বারবার বাংলাদেশের সীমানা লঙ্ঘন করেছে।

এ পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে চারবার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয় হলো, মিয়ানমারের সামরিক শাসক দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংকটের পাশাপাশি সামরিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটাচ্ছে, গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করতেও পিছপা হচ্ছে না। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। সম্প্রতি তারা একটি স্কুলে আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন শিশুকে হত্যা করেছে। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে তারা হত্যা করেছে। জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ব নেতৃত্ব এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করলেও সামরিক জান্তার উন্মত্ততা হ্রাস না পেয়ে ক্রমেই বেড়েছে।

মিয়ানমারের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এবং বিদ্যমান রোহিঙ্গা সঙ্কট এই গোটা অঞ্চলকে বড় হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তারা এ অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য বৃহৎ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশ এখনো শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক উসকানি শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবেলা না করলে এ অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করতে চাইছে। মিয়ানমারের যে নিন্দিত, বেপরোয়া ও উসকানিমূলক আচরণ সীমান্তে দেখা যাচ্ছে, তার সাথে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও জড়িত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর মিয়ানমার জান্তা দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ চাপে রয়েছে। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আরাকান আর্মির সাথে তাদের তুমুল সঙ্ঘাত।

সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, জান্তা সরকার দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ ভূমিতে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এনইউজি তথা মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ৫২ শতাংশ অঞ্চলে। বাকি অংশের আধিপত্য নিয়ে চলছে সঙ্ঘাত। রাখাইনে আরাকান আর্মির সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ তারই অংশ। এসব যুদ্ধে জান্তা সরকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর জেরে এক ধরনের নাজুক রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যা-ই থাকুক; সীমান্ত লঙ্ঘন হওয়া অথবা সীমান্তের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর।

বাংলাদেশ সীমান্তে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটাই প্রমাণ করছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কতটা বেপরোয়া। পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে; রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে রয়েছে; গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাথে নিয়মিত সঙ্ঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মিয়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এত চাপের মধ্যেও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাইওয়ান সঙ্কট এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

মিয়ানমার অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, যা প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখারও পরিপন্থী। এসব ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদি তা-ই হয় তাহলে তা মিয়ানমারের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না, বাংলাদেশ বা আঞ্চলিক অন্য দেশগুলোর স্বার্থেও যাবে না। অস্থিতিশীল রাখাইন রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এবং মর্যাদার সাথে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি। অস্থিতিশীল সীমান্ত সেখানে বসবাসকারীদের জন্য হুমকি। তাই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের উস্কানির প্রতিবাদ জানানো এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমারের আচরণের বিহিত করা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের জন্য অপরিহার্য। তা করা উচিত উভয় দেশ এবং এ অঞ্চলের স্বার্থের জন্য। বাংলাদেশ কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রতিক ও আগের সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে তুলে ধরতে হবে।

মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখাটাই কূটনীতির অংশ হওয়া উচিত। এমনিতেই আমরা ১১ লাখের বেশি মিয়ানমারের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি, যা আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত তো নিচ্ছেই না, উলটো বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের নিক্ষেপ করা মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়ছে। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কূটনৈতিক পন্থায় এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। সেটি যেমন মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে, তেমনি জাতিসঙ্ঘের কাছে সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মধ্যস্থতার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে সহায়তাও চাইতে পারি আমরা। এ ব্যাপারে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক দেশগুলোকে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে আসিয়ান, চীন, রাশিয়া ও জাতিসঙ্ঘকে মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত বন্ধে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত যেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা না দেয় সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো দেশগুলো আগে থেকেই মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরব রয়েছে এবং বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। কিন্তু এসব রাষ্ট্রের মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে বলে মনে করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে আসিয়ান অধিভুক্ত দেশগুলো এখন যেমন মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, তেমনি চীন এবং ভারতকে এ রকম ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে এই দু’টি রাষ্ট্র সমর্থন প্রদান করেছিল। এখনো যদি তারা সমর্থন অব্যাহত রাখে, তা হলে এ অঞ্চলকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এমনকি এই দু’টি দেশের যে বিশাল বিনিয়োগ মিয়ানমারে রয়েছে, যে কানেক্টিভিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটাও ব্যাহত হতে পারে। বাংলাদেশ তাই বহু আগেই বলে আসছে, মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাত শুধু দু’টি দেশের বিষয় নয়, এটি একটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিষয়। ফলে এখনই দরকার জাতিসঙ্ঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করার অপতৎপরতা বন্ধ করার ব্যাপারে আলোচনা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করা। তা না হলে এখানকার আঞ্চলিক শান্তি বিপন্নতার হুমকিতে পড়তে বাধ্য হবে।

পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, সীমান্তে মিয়ানমারের উস্কানীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সামরিক মহড়ার মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতির কথা জানান দেয়া যেতে পারে। কোনো নরম বা গড়িমসি জবাব নয়। আমরা নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ। স্বাভাবিকভাবে গায়ে পড়ে কারো সাথে বিরোধকে আমরা প্রশ্রয় দেই না। তবে সীমা অতিক্রম করা হলে বা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কিছু হলে তার কঠোর জবাব দিতে বাঙালি কখনো পিছপা হয় না। কেননা বাঙালি অতীতে কখনোই ভীরুতার বা দুর্বলতার পরিচয় দেয়নি। তাদের রক্তে সংগ্রামী চেতনার বীজ বোপিত আছে। তার সামান্য পরিচর্যাতেই আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি। যদিও অনেকে বলে থাকেন- সামরিক কলাকৌশল ও অস্ত্র-সরঞ্জামের দিক থেকে মিয়ানমার নাকি অনেক দূর এগিয়ে। যাই হোক আমাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখোমুখি হলে জীবনবাজি রেখে হলেও আমরা আমাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় ত্যাগের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক, সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com