ছয় মাস ১২ দিনে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। যেখানে পুরো বছরের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাস ১২ দিনেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চার হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেভাবে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে, এটা অব্যাহত থাকলে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ ছেড়ে যাবে এ ব্যাংক ঋণ। এতে চাপে পড়ে যাবে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারের ব্যয়ের প্রবণতা বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে নানা খাতে ব্যয়। কিন্তু ব্যয় অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।
অপর দিকে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীও আর আগের মতো বিদেশী ঋণ অবমুক্ত করছে না। পাশাপাশি বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকেও আগের মতো সরকার ঋণ পাচ্ছে না। সবমিলিয়ে বাজেট ঘাটতি বেড়ে গেছে। আর এ ঘাটতি মেটানোর জন্যই ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে।
সাবেক এ গভর্নরের মতে, স্থানীয় পর্যায়ে ঋণ নিলে সরকারের জবাবদিহিতা কম করতে হয়। কিন্তু দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নিলে নানা জবাবদিহিতা করতে হয়। সবমিলিয়ে সরকার স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ওপরই নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ চাপে পড়ে যাবে বলে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন।
তিনি বলেন, যে হারে সরকার ঋণ নিচ্ছে তাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের ঋণের জোগান দিতেই হিমশিম খেতে হবে। বেসরকারি ঋণ দেয়ার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকবে না। কারণ মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখা এর মধ্যে কমিয়ে দিয়েছে। অপর দিকে ব্যাংক থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে ব্যাংকগুলোও সমস্যায় পড়ে যাবে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, সরকারের এ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকও সাপোর্ট করছে। ইতোমধ্যে মুদ্রানীতি সংশোধন করে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে, যা মোটেও ঠিক হয়নি। এটা অর্থনীতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না বলে মনে করছেন সাবেক এ গভর্নর।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক তার এক বছরমেয়াদি মুদ্রানীতিতে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। সম্প্রতি এ মুদ্রানীতি পরিবর্তন করে জানানো হয়, মুদ্রানীতিতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। তা বাড়িয়ে আগামী জুন শেষে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
যদিও ডিসেম্বর শেষে সরকারের ঋণ বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ। তবে বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশেই রাখা হয়েছে। যদিও ডিসেম্বর শেষে তা বাস্তবায়ন হয়েছে ১০ শতাংশের কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ার অন্যতম কারণ হলো সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া। চলতি বছরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সাথে আরো কিছু নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর ফলে গ্রাহক আর আগের মতো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন না।
যেমন সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ কমেছে ৭৩ শতাংশ।
দ্বিতীয় কারণ হলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। যেমন- চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ, যেখানে আগের বছরে ছিল প্রায় ৮ শতাংশ। অপর দিকে কাঙ্খিত হারে বিদেশী ঋণ অবমুক্ত হচ্ছে না। কিন্তু সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যয় বেড়ে গেছে। এ ব্যয় নির্বাহের জন্যই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাস ১২ দিনে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণ নেয়ার পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলছে। এভাবে ঋণ নেয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এতে চাপে পড়ে যাবে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ।
ইতোমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। সামনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনিতেই ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেশির ভাগ ব্যাংকেই নগদ টাকার সঙ্কট চলছে।
এ ব্যাংক থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণের জোগান দিতে হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করার মতো তহবিল তাদের হাতে থাকবে না বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো ও বিশেষ রেপোর মাধ্যমে ধার করে চলছে। সামনে এ সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেলে কাঙ্খিত হারে কর্মসংস্থানও বাড়বে না। এতে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। সবমিলিয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।