ভালো খবর সব সময়ই কম পাওয়া যায়, পাওয়া গেলেও মনে ধরে না, মনে থাকেও না; কিন্তু খারাপ খবরগুলো দাগ কেটে বসে যায়, সে জন্য বিশেষভাবেই ধারণা হয় যে সেই সংখ্যা অধিক। বাংলাদেশে খারাপ খবরের এই আধিক্য অনেক কালের, এগুলোর প্রবহমানতার পুরনো ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রয়েছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়নে ধর্মের বাহ্যিক উপস্থিতি রয়েছে, কিন্তু ধর্ম এখানে অস্ত্র ও আবরণ মাত্র। সাম্প্রদায়িকতা প্রকৃত ধার্মিকদের কাজ নয়, এটি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের কাজ।
এ ধরনের অনেক সংগঠন বলছে তারা রাজনীতি করছে না। প্রশ্ন হলো, তাহলে তারা কী করছে? ধর্মকর্ম? ধর্মকর্ম করার জন্য তো নিজেদের ঘরবাড়ি আছে, পাড়ায়-মহল্লায় মসজিদ রয়েছে। এ ধরনেরই একটি সংগঠন ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি এবং সহিংস তাণ্ডব করেছিল কেন? তা ছাড়া যে দাবিগুলো তারা তুলেছে, তাদের প্রত্যেকটিই রাজনৈতিক। বহু সংগ্রাম ও অকল্পনীয় আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র; সেই রাষ্ট্রের নিজস্ব চরিত্রটিই তারা বদলে দিতে চায়, দেশবাসীকে নিয়ে যেতে চায় মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। এসব সংগঠনের বেশির ভাগ কর্মীই এসেছেন মাদরাসা শিক্ষার ধারা থেকে। এ দেশে মাদরাসা শিক্ষা সামাজিক সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করেনি। উপরন্তু বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। স্বাধীনতার পর যত সরকার এসেছে, কেউই মাদরাসা শিক্ষা নিরুৎসাহ করার কথা ভাবেনি; উল্টো প্রতিযোগিতামূলকভাবে ওই শিক্ষার বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এর পেছনেও রয়েছে দুটি রাজনৈতিক বিবেচনা। প্রথমটি হলো, মাদরাসা শিক্ষিতদের ভোটগুলো হস্তগত করা; দ্বিতীয়টি হলো, মাদরাসা শিক্ষার মধ্য দিয়ে গরিব মানুষকে গরিব অথচ সন্তুষ্ট রাখার পরিকল্পনা। এ দেশের শাসক শ্রেণি গরিবের স্বার্থ দেখে না, গরিব মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে—এটা তাদের জন্য এক মহা আতঙ্ক।
আমাদের দেশের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ক্ষমতার, অন্যটি মুক্তির। ক্ষমতার রাজনীতি শাসক শ্রেণির স্বার্থ দেখে, মুক্তির রাজনীতি দেশের সব মানুষের মুক্তি ও উন্নতি চায়। এরা পরস্পরের প্রতিপক্ষ। রাজনীতির এই দ্বৈত ধারা এ দেশে দীর্ঘকাল ধরে প্রবহমান। ক্ষমতার রাজনীতিই দাপটের সঙ্গে কর্তৃত্ব করছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ ও যন্ত্রণা নিয়ে আসছে। মুক্তির রাজনীতিতে যাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ তাঁরাও দেখা যায় একসময় ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ এবং বিশ্বব্যবস্থা মুক্তির রাজনীতির পুরোপুরি বিরোধী। ফলে দুর্বল মানুষেরা শুধু নির্যাতিত নয়, ব্যবহৃতও হয়। ধর্মীয় দলগুলোর বেশির ভাগ মানুষই বঞ্চিত শ্রেণির, কিন্তু তাঁরা তাঁদের নেতাদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছেন, যেমনভাবে পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা পরিণত হচ্ছেন জীবন্ত কঙ্কালে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের সম্পত্তি, উপাসনালয়, এমনকি প্রাণও হারাচ্ছে।
ক্ষমতার রাজনীতির এই দোর্দণ্ড প্রতাপকে পরাভূত করতে হলে মুক্তির রাজনীতিকে বেগবান করা দরকার। সমষ্টিগত জীবনের দুঃসংবাদগুলো এই কথাটিই ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠে বারবার বলে, এবারও বলল। আমরা যে শুনছি না সেটাও একটা দুঃসংবাদ বৈকি। বড় মাত্রার দুঃসংবাদ।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দুটি অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি। এ দুই বস্তু আমাদের দেশে আগে ছিল না, এখনো নেই। পৃথিবীর যেসব দেশ গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, সেখানে এরা আছে বলে বলা হয়, কিন্তু খুব যখন প্রয়োজন পড়ে তখন দেখা যায় তারা নেই। আমেরিকার নেতৃত্বে যখন পুঁজিবাদী বিশ্বের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল চলল, তখন সেই ঘটনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছিল—এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। দাবি করা হয়েছিল, ইরাকে এমন সব ওয়েপনস অব মাস ডেসট্রাকশন রয়েছে, যেগুলোর একটি মাত্র আঘাত অসংখ্য মানুষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট; পইপই করে খোঁজা হলো, কিন্তু আক্রমণ-উন্মাদরা তেমন কোনো অস্ত্রের খবর বিশ্ববাসীকে দিতে পারল না। তবু দখল করা হলো, হত্যা এবং রক্তপাতের কোনো সীমা-পরিসীমা রইল না, কিন্তু না দেখা গেল স্বচ্ছতা, না দায় রইল জবাবদিহির। আফগানিস্তান দখলের অজুহাত ছিল তালেবানদের হটানো, যে তালেবানরা একদা মার্কিনদের হাতেই তৈরি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব থেকে আফগানিস্তানকে ‘মুক্ত’ করার জন্য। সে দেশে মানুষ ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে বিপুল; তালেবানরা নিশ্চিহ্ন হয়নি, তারা নানা উপায়ে ফিরে এসেছে। আফগানিস্তানের ধ্বংসকাণ্ডের জন্য আমেরিকাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি—না বিশ্ববাসীর কাছে, না নিজ দেশের জনগণের কাছে।
স্বচ্ছতা থাকলে ধরা পড়ত যে উভয় ক্ষেত্রেই আসল উদ্দেশ্য ছিল দেশ দুটির জ্বালানি তেল ও খনিজ সম্পদ হস্তগত করা; সেই সঙ্গে ছিল সমরাস্ত্র তৈরি এবং সেনাবাহিনীতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। আমেরিকা এটাও দেখাতে চেয়েছে যে তারা দুর্ধর্ষ, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা করছে, সে জন্য কারো কাছে জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। কোন যুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে তাদের বাসভূমি দখল করে বসে আছে, তার জবাবও ইসরায়েল কখনো দেয়নি, দেবেও না।
আমাদের নিজেদের দেশেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিলক্ষণ অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার বাধ্যবাধকতা মানা হয় না। সংসদের কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেশে কোনো বিরোধী দলের উপস্থিতি আছে বলে টের পাওয়া যায় না। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়, অপরাধীরা ধরা পড়ে না। সরকারি ব্যাংক থেকে হলমার্কওয়ালারা কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করল, সেটা রহস্যই রয়ে যায়। সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতিকে কারা এবং কেন হত্যা করল, সেটা পরিষ্কার হয় না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফান্ড তলানিতে ঠেকেছে। ব্যাংকগুলো ডলারের অভাবে এলসি বন্ধ রেখেছে। কারা দুর্নীতি, লুণ্ঠনে মুদ্রাপাচার করেছে? সরকারের সদিচ্ছার অভাবে সেটাও জানা যাচ্ছে না। খাদ্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি নেই। নাভিশ্বাস উঠেছে সর্বত্র। এ ধরনের বড় বড় ঘটনার ক্ষেত্রেই যখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চিহ্ন পাওয়া যায় না, তখন ছোটখাটো অপরাধের যারা ভুক্তভোগী তারা ন্যায়বিচার পাবে এমন আশা নিশ্চয়ই বাস্তবসম্মত নয়। বাস্তবেও তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে; খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দিক দিয়ে দেশ এখন ঘটনাবহুল। অভাব শুধু ওই দুই বস্তুর—স্বচ্ছতার ও জবাবদিহির, যেগুলোর অভাব ঘটলে গণতন্ত্র আছে এমনটা বলা মুশকিল।
কিন্তু গণতন্ত্র তো এমনি এমনি আসে না, তার জন্য চাপের দরকার পড়ে। আর সেই চাপটা দিতে পারে অন্য কেউ নয়, জনসাধারণই। যে জন্য প্রতিটি দেশেই জনগণের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় শাসক শ্রেণিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুশীলনে বাধ্য করা। নিজের দেশে গণতন্ত্র এলে তবেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা সম্ভব। সুখের বিষয় এইটুকুই যে বোধটা পৃথিবীব্যাপী এখন পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে, আমাদের দেশেও এই বোধের বিকাশ ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। নইলে যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন, গণতন্ত্র আকাশকুসুমই রয়ে যাবে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়